নবাবগঞ্জের মুসলিহুল উম্মাহ মাদানী মাদ্রাসায় ৫ শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড়। হাফেজ ওয়াসিমের পলায়নের ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে— ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু নিরাপত্তা কোথায়?
ঢাকার নবাবগঞ্জের মুসলিহুল উম্মাহ মাদানী মাদ্রাসায় ৫ শিশু শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের ভয়াবহ অভিযোগ শুধু এক শিক্ষকের বিকৃত মানসিকতার প্রতিচ্ছবি নয়— এটি আমাদের ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার এক গভীর নৈতিক সংকটের প্রতিফলন। ধর্মের নামে যে প্রতিষ্ঠানগুলো শিশুদের নৈতিকতা শেখানোর কথা, সেখানে যখন নৃশংসতা ঘটে, তখন প্রশ্ন উঠতেই পারে— এই ব্যবস্থার জবাবদিহি কোথায়?
ঘটনার নায়ক, শিক্ষক হাজেফ মো. ওয়াসিম, পেশায় হাফেজ হলেও কর্মে এক অমানবিক শিকারি।
মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পলায়ন শুধু অপরাধবোধ নয়, বরং প্রশাসনিক ব্যর্থতার দিকটিও উন্মোচন করে।
নবাবগঞ্জ থানায় দায়ের হওয়া মামলাটি কেবল এক শিশুর পক্ষে দায়ের হলেও, একই প্রতিষ্ঠানে একাধিক শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ থাকায় এখানে “সিরিয়াল অ্যাবিউজার”-এর ধারণাটি স্পষ্ট।
অথচ পুলিশের বক্তব্য— “একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পৃথক মামলা নেওয়া হয়নি”— আমাদের বিচারব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে।
প্রশ্ন হলো, শিশুদের শারীরিক-মানসিক ট্রমা কি এক মামলার আওতায় বিচার পাবে?
প্রতিটি শিশুর ক্ষত আলাদা, প্রতিটি ভয়ের গল্প আলাদা— তবে আইনের চোখে কেন তারা এক হয়ে যায়?
শিশুরা জানিয়েছেন, “হুজুর বলেছেন কাউকে না বলতে, বললে মারবে।”
এই ভয়ভীতি আমাদের সমাজে ‘ধর্মীয় কর্তৃত্ব’-এর এক অন্ধ মানসিকতার ফল।
শিক্ষক বা হুজুরদের কথাই শেষ সত্য বলে মেনে নেওয়ার প্রবণতা এমন অপরাধকে বারবার আড়াল দিয়েছে।
মাদ্রাসাগুলোয় প্রায়ই ‘শিক্ষার শৃঙ্খলা’ বা ‘আদব শেখানো’-র আড়ালে শিশুদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ঘটে।
কিন্তু অভিভাবকেরা মুখ বন্ধ রাখেন— কারণ তারা ভাবেন, “হুজুররা ভুল করতে পারেন না।”
এই চেতনা বদলানোই এখন সময়ের দাবি।
দায় কার?
মাদ্রাসা প্রশাসন: শিক্ষক নিয়োগ ও পর্যবেক্ষণে সম্পূর্ণ অবহেলা।
অভিভাবক সমাজ: শিশুদের অস্বস্তির ইঙ্গিত উপেক্ষা করা।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা: যৌন নির্যাতনের একাধিক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও পৃথক মামলা না নেওয়া।
সমাজ: ধর্মীয় ভয়ে নীরবতা বজায় রাখা।
যদি এসব প্রশ্নের জবাব না মেলে, তবে আগামী দিনে “মাদ্রাসা” শব্দটি শিক্ষা নয়, ভয়ের প্রতীক হয়ে উঠবে।
- প্রতিটি মাদ্রাসায় চাইল্ড প্রোটেকশন পলিসি বাধ্যতামূলক করা।
- স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে অভিযোগ গ্রহণ সেল গঠন।
- শিক্ষকদের মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়ন ও ব্যাকগ্রাউন্ড চেক বাধ্যতামূলক করা।
- শিশুদের মধ্যে শরীর সচেতনতা ও আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ চালু করা।
নবাবগঞ্জের এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়— এটি সমাজের গোপন ক্ষতের উন্মোচন।
আমরা যদি এই মুহূর্তে কঠোর অবস্থান না নেই, তবে শিশুদের নিরাপত্তা কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকবে।
ধর্মের ছায়ায় বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের যেন আর অন্ধকারের বলি হতে না হয়— এখনই জবাবদিহির সময়।
