হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিএনপি–জামায়াত সরকারের সময়ে (২০০৪–২০০৬) দেশে ৭৩৮ জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বাধিক ২৩৬ জন। অথচ সেই সময়ের কর্মকর্তারাই আজ মানবাধিকার রক্ষার বুলি আওড়াচ্ছেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রকাশিত এক ঐতিহাসিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে— বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের সময়, ২০০৪ সালের ২৪ জুন থেকে ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশজুড়ে ৭৩৮ জন মানুষকে ‘ক্রসফায়ার’ নামে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম বিভাগেই নিহত হন ২৩৬ জন, যা দেশের যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় সর্বাধিক।
এই তথ্যগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়— এটি এক ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দলিল, যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকে “আইনশৃঙ্খলা রক্ষা”র নামে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে,
সেই সময় চট্টগ্রামে র্যাবের সিইও ছিলেন কর্নেল এমদাদ, এবং বিশেষ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর হাসিনুর রহমান, যিনি পরবর্তীতে “ক্রসফায়ার স্পেশালিস্ট” হিসেবে কুখ্যাত হন।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় যেসব অভিযানে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল— তার বহু ক্ষেত্রেই এই দুজন কর্মকর্তার নাম উঠে আসে।
বিদ্রূপের বিষয় হলো, আজ সেই হাসিনুর রহমানই মিডিয়ায় নিজেকে “মানবাধিকার কর্মী” হিসেবে পরিচয় দেন এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ।
অথচ তাঁর অতীত কর্মকাণ্ডের পাতা খুললেই বেরিয়ে আসে শত শত প্রাণহানির ভয়াবহ ইতিহাস।
২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের এই সময়টিতে দেশে আইনের শাসন ভেঙে পড়ে, মানবাধিকারের জায়গা দখল করে নেয় রাষ্ট্রীয় নির্যাতন।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সন্দেহভাজন অপরাধী, এমনকি সাধারণ মানুষকেও তুলে নিয়ে যাওয়া ও ‘ক্রসফায়ার’-এ হত্যার অভিযোগে দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
তৎকালীন সরকার এই হত্যাগুলিকে ‘অপরাধ দমন অভিযান’ হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও, বাস্তবে তা ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং ভয় সৃষ্টির হাতিয়ার।
আজকের মানবাধিকার বিতর্কে অতীতের প্রতিধ্বনি
বর্তমান সময়ে যারা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের ভাষা ব্যবহার করছেন, তাদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি নিজেই এক সময়ের “ক্রসফায়ার আর্কিটেক্ট”।
এই দ্বিচারিতা শুধু নৈতিক প্রশ্নই তোলে না, বরং বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এক সময় যারা বন্দুকের নলের নিচে বিচার প্রতিষ্ঠা করতেন, আজ তারাই মানবাধিকার রক্ষার বক্তৃতা দিচ্ছেন—
এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতিতে নৈতিক ভণ্ডামির সবচেয়ে প্রকট উদাহরণ।
মানবাধিকারের লঙ্ঘন যেকোনো সময়, যেকোনো সরকারের আমলেই নিন্দনীয়।
কিন্তু ইতিহাস বিকৃত করা কিংবা অতীতের পাপ গোপন রেখে বর্তমানের বিচার চাওয়া— সেটি মানবাধিকারের ভাষা নয়, বরং রাজনীতির অভিনয়।
২০০৪–২০০৬ সালের ‘ক্রসফায়ার’ অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
যখন রাষ্ট্রের হাতে জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত বন্দুকবাহিত বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়, তখন মানবতা, ন্যায়বিচার, ও গণতন্ত্র—সবকিছুই হারিয়ে যায় অন্ধকারে।
