ইতালির প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর স্থগিত হওয়ায় আবারও প্রশ্ন উঠেছে ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও কূটনৈতিক অবস্থান নিয়ে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর স্থগিত হওয়ায়।
আগামী ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির ঢাকা সফর নির্ধারিত ছিল। এই সফরকে ঘিরে ইউনূস সরকারের প্রচার টিম সামাজিকমাধ্যম ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইতালির তরফ থেকে জানানো হয়েছে—সফরটি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।
ঢাকায় নিযুক্ত ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দ্রো রোববার (২৬ অক্টোবর) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন,
“আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল, কিন্তু কিছু রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের কারণে এখন সেটি পুনঃনির্ধারণ করতে হচ্ছে।”
রাষ্ট্রদূতের এই মন্তব্যের পর কূটনৈতিক মহলে জল্পনা শুরু হয়েছে—এটি কি কেবল ক্যালেন্ডারজনিত পরিবর্তন, নাকি ইউনূস সরকারের প্রতি ইউরোপীয় আস্থাহ্রাসের সংকেত?
ড. ইউনূসের কূটনৈতিক প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
গত কয়েক মাস ধরে ড. ইউনূস ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সফরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল—বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাড়ানো।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী মেলোনির সফর সেই প্রচেষ্টার সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে প্রচারিত হচ্ছিল।
কিন্তু সফর স্থগিত হওয়ায় সেই কূটনৈতিক সম্ভাবনা হোঁচট খেয়েছে।
একজন পররাষ্ট্র বিশ্লেষক বলেন,
“ইউনূস সরকার যে আন্তর্জাতিক পরিসরে পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, সেটিরই প্রতিফলন ঘটেছে মেলোনির সফর স্থগিতের মধ্য দিয়ে।”
ইতালির অবস্থান ও কূটনৈতিক ইঙ্গিত
রাষ্ট্রদূত আলেসান্দ্রো জানিয়েছেন, সফর স্থগিতের কারণ হিসেবে “রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার” উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তিনি একইসাথে বলেন—
“আমরা নতুন তারিখ নিয়ে কাজ করছি এবং শিগগিরই ঘোষণা দেওয়া হবে।”
যদিও ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট বা অফিসিয়াল বিবৃতিতে সফর সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত তারিখ বা বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি।
এতে ধারণা করা হচ্ছে, ইতালির কূটনৈতিক মহলে ইউনূস সরকারের স্থায়িত্ব ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অনিশ্চয়তা বিদ্যমান।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্প্রতিক বিবৃতি অনুযায়ী, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক নিপীড়নের অভিযোগে বেশ কিছু উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
সফরের সম্ভাব্য আলোচ্য বিষয়
ইতালির রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, এই সফরে প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলো হতে যাচ্ছিল—
- অভিবাসন ও শ্রমবাজার চুক্তি নবায়ন
- বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বৃদ্ধি
- দ্বিপাক্ষিক সামরিক সহযোগিতার সম্ভাবনা
ইতালি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার। সেখানে প্রায় ২ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী কাজ করছেন, যাদের বার্ষিক রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ফলে সফরটি শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক দৃষ্টিতেও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
ইউনূসের জন্য রাজনৈতিক ও ভাবমূর্তির ধাক্কা
গত কয়েক মাসে ড. ইউনূস একাধিক ইউরোপীয় নেতা ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ক্রমেই তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের মানবাধিকার রেকর্ড ও প্রশাসনিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিলের ঘটনাটি শুধু কূটনৈতিক নয়, বরং ইউনূসের ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতারও প্রতিফলন হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, মেলোনির সরকার সাধারণত উন্নয়নশীল দেশের নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সক্রিয়, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে।
এমন অবস্থায় সফর স্থগিত হয়ে যাওয়া কেবল ক্যালেন্ডার ইস্যু নয়—বরং ইউনূস সরকারের কূটনৈতিক অবস্থান কতটা নড়বড়ে, তার একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে।
শেষকথা
ইতালির প্রধানমন্ত্রীর সফর স্থগিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো—ড. ইউনূস সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থা এখনো অনিশ্চিত ও বিভক্ত।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর ইউরোপীয় দেশগুলোর অবস্থান অনেকাংশে নির্ভর করছে আসন্ন মাসগুলোর ঘটনাপ্রবাহের ওপর।
যদি সরকার অভ্যন্তরীণ বৈধতা ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা—দুটিই শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়, তবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা আরও গভীর হতে পারে।
