ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করিমের সাম্প্রতিক বক্তব্যে উঠে এসেছে বিএনপিকে ঘিরে ভয়-মনস্তত্ত্ব ও রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা। বক্তব্যটি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বর্তমান কৌশল ও জনমত প্রভাবের নতুন রূপ উন্মোচন করছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি মুহাম্মদ ফয়জুল করিমের বক্তব্য—“বিএনপি ক্ষমতায় এলে সুন্দরী নারীরাও রাস্তায় বের হতে পারবে না”—সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুলেছে। বরিশালের বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজ মাঠে আয়োজিত গণসমাবেশে এই বক্তব্য শুধু দলীয় অবস্থান নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভয়-মনস্তত্ত্ব (politics of fear) কে কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তারও এক উদাহরণ।
ফয়জুল করিমের বক্তব্যে বিএনপিকে চাঁদাবাজ, ধর্ষণকারীদের আশ্রয়দাতা ও খুনের রাজনীতির বাহক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “বিএনপি যদি ক্ষমতায় যায়, ঘুমাতে পারবেন না, ব্যবসা করতে পারবেন না।”
এই ধরণের ভাষ্য শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সমালোচনা নয়; বরং জনগণের মনে এক ধরণের নৈতিক আতঙ্ক (moral panic) সৃষ্টি করে—
যেখানে বিরোধী দলকে সামাজিক বিপর্যয়ের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ্বন্দ্বের বাইরে’ একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়।
কিন্তু বাস্তব রাজনীতিতে এই অবস্থান টিকিয়ে রাখতে তারা প্রায়ই প্রধান দুই দলের দুর্নীতি ও ব্যর্থতাকে ব্যবহার করে জনমত আহরণ করে।
ফয়জুল করিমের বক্তব্যেও সেই কৌশলের প্রতিফলন রয়েছে—যেখানে তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়কেই একসঙ্গে দুর্নীতি, দখলদারি ও বৈষম্যের দায়ে অভিযুক্ত করেছেন।
“সুন্দরী নারীরা রাস্তায় বের হতে পারবে না”—
এই অংশটি শুধু রাজনৈতিক সমালোচনা নয়; বরং বাংলাদেশের সামাজিক মানসিকতায় নারীর স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণের এক ধরণের প্রতীকী বার্তা।
ইসলামী আন্দোলনের রাজনীতিতে ‘নৈতিক রাষ্ট্র’ ধারণা একটি মূলমন্ত্র, যেখানে নারীর উপস্থিতি বা স্বাধীনতাকে প্রায়ই নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয়।
ফয়জুল করিমের এই মন্তব্যে তাই দ্বৈত বার্তা আছে—একদিকে বিএনপির বিরুদ্ধে ভয় তৈরি করা, অন্যদিকে তাদের নিজস্ব নৈতিক রাজনীতির অবস্থানকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বার্তা
বক্তব্যের শেষাংশে তিনি ‘সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি’ (Proportional Representation – PR) ও ‘গণহত্যার বিচার’ বাস্তবায়নের দাবি জানান।
এটি কেবল একটি রাজনৈতিক ইস্যু নয়, বরং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা ও জনআস্থার প্রশ্নেও প্রভাব ফেলতে পারে।
ইসলামী আন্দোলন স্পষ্টতই চাইছে—
অন্তর্বর্তী সরকার যদি নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চায়, তবে তাদের এই দাবিগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।
ফয়জুল করিমের বক্তব্যকে শুধুমাত্র এক বক্তার অতিরঞ্জিত মতামত হিসেবে দেখলে ভুল হবে।
এটি বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির একটি কৌশলগত বিবর্তন—
যেখানে নির্বাচনী সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে “আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়ের ব্যর্থতা” তুলে ধরে নিজেদের ‘নৈতিক বিকল্প’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—ভয় এবং নৈতিক আতঙ্কের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক আস্থা অর্জন করা সম্ভব কি?
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ফয়জুল করিমের বক্তব্য কেবল একটি দলীয় ভাষণ নয়, বরং জনমত প্রভাবিত করার মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র।
তিনি বিএনপিকে কেন্দ্র করে যে ভয়-রাজনীতি উস্কে দিয়েছেন, তা আগামী নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ইসলামী আন্দোলনের অবস্থান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে দীর্ঘমেয়াদে এই ধরনের ভাষ্য ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে—বিশেষ করে যখন জনগণ বাস্তব অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমাধান চায়, ভয় নয়।
