গাজীপুরে আলোচিত আলেম মুফতি মুহিব্বুল্লাহর অপহরণের নাটক ফাঁস করেছে পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজে প্রমাণিত—তিনি স্বেচ্ছায় পঞ্চগড়ে গিয়েছিলেন।
গাজীপুরের টঙ্গীর আলোচিত আলেম মুফতি মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী (৬০), যিনি সামাজিক মাধ্যমে ‘মাওলানা মুফতি মুহিব্বুল্লাহ মাদানী’ নামে পরিচিত, তাঁর রহস্যজনক নিখোঁজ ও কথিত অপহরণের ঘটনার নাটকীয় পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
পুলিশ বলছে, এই ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত এক “অপহরণ নাটক”, যেখানে মুফতি নিজেই কাহিনির নায়ক এবং পরিচালক।
ঘটনা ও অভিযোগের সূচনা
২৪ অক্টোবর টঙ্গী পূর্ব থানায় মুফতি মুহিব্বুল্লাহ নিজে অপহরণের মামলা দায়ের করেন।
এজাহারে তিনি দাবি করেন—২২ অক্টোবর সকালে টঙ্গীর শিলমুন এলাকায় একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে তাকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে অজ্ঞাত চার–পাঁচজন লোক অপহরণ করে।
তাদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতন ও চোখ বেঁধে একাধিক স্থানে ঘোরানো হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, পরে স্থানীয়দের সহায়তায় তিনি পঞ্চগড়ে উদ্ধার হন।
এই অভিযোগ দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং আলোচনার ঝড় তোলে—একজন জনপ্রিয় আলেমকে ‘অপহরণ’ করা হয়েছে, সরকারের সমালোচক হওয়ায় তিনি টার্গেট হয়েছেন—এমন দাবি তুলেছিলেন তাঁর অনুসারীরা।
পুলিশের তদন্ত ও সিসিটিভির চমক
ঘটনা তদন্তে নামে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি)।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) তাহেরুল হক চৌহান তদন্ত দলের নেতৃত্ব দেন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, তাঁরা টঙ্গী থেকে গাবতলী পর্যন্ত প্রতিটি সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখেন।
ফুটেজে দেখা যায়—মুফতি মুহিব্বুল্লাহ একা হেঁটে নিজের বাসা থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন এলাকা পেরিয়ে ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনালে পৌঁছান।
তিনি সেখানে শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার থেকে পঞ্চগড়গামী বাসের টিকিট কেনেন এবং ‘E-1’ নম্বর আসনে বসেন।
বাসের যাত্রাবিরতির সময় বগুড়ার পেন্টাগন হোটেলে নামাজ পড়ছেন—সেই দৃশ্যও ধরা পড়ে হোটেলের সিসিটিভিতে।
অর্থাৎ, যেই সময়ে তিনি বলেছিলেন তাঁকে অপহরণ করে অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হয়েছে, সেই সময়ে তিনি নিজেই স্বেচ্ছায় যাত্রা করছিলেন।
পুলিশের জেরা ও স্বীকারোক্তি
তথ্যপ্রমাণ দেখানোর পর মুফতি মুহিব্বুল্লাহ ভেঙে পড়েন। পুলিশের জেরায় তিনি বলেন—
“আমি হাঁটতে গেছি। হাঁটতে গিয়ে মাথায় এলো আমি আরও একটু যাই। তারপর বাসে উঠলাম। কোথায় যাব জানতাম না। শেষে পঞ্চগড় পর্যন্ত চলে গেলাম।”
তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তিনি উদ্দেশ্যহীনভাবে বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে গাবতলী পৌঁছান, সেখান থেকে বাসে পঞ্চগড়ে যান।
পঞ্চগড়ে নেমে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পথ হারিয়ে ফেলেন, একপর্যায়ে নিজের পায়ে কুড়িয়ে পাওয়া শিকল বেঁধে ফেলেন—যা পরবর্তীতে ‘অপহরণের প্রমাণ’ হিসেবে ভাইরাল হয়।
পুলিশের মন্তব্য
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার তাহেরুল হক চৌহান সাংবাদিকদের জানান—
“মুহিব্বুল্লাহ প্রথমে গল্প বানিয়ে বলেছিলেন, তাকে অপহরণ করা হয়েছে। কিন্তু সব তথ্যপ্রমাণ দেখানোর পর তিনি স্বীকার করেন, তিনি নিজেই পুরো ঘটনাটি সাজিয়েছেন।”
তিনি আরও জানান, এখনো পরিষ্কার নয় কেন তিনি এই নাটক সাজালেন বা কেউ তাঁকে প্ররোচিত করেছিল কি না।
তদন্ত চলমান, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইনি প্রেক্ষাপট ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ী,
‘ভুয়া অপহরণ মামলা বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি’ করা একটি ফৌজদারি অপরাধ।
যদি প্রমাণিত হয় কেউ সচেতনভাবে মিথ্যা অভিযোগ দেয় বা তদন্ত বাধাগ্রস্ত করে,
তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনার মোড় ঘুরতেই ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে।
অনেকে বলছেন, “ধর্মীয় পরিচয়ের আড়ালে” সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টির এমন প্রবণতা উদ্বেগজনক।
বিশ্লেষণ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন,
এই ঘটনা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মানসিক বিপর্যয়ের ফল নয়,
বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাব খাটাতে বিভ্রান্তিকর প্রচারণার একটি অংশ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
এমন অপপ্রচার একদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সহানুভূতিকে ব্যবহার করে ধর্মীয় আবেগের রাজনীতি চালানোর সুযোগ করে দেয়।
মুফতি মুহিব্বুল্লাহর ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও বাস্তব চিত্র প্রকাশের মাধ্যমে
পুলিশ যে ডিজিটাল প্রমাণের ব্যবহার ও পেশাদার তদন্ত প্রক্রিয়ায় উন্নতি দেখিয়েছে, তা আইনশৃঙ্খলার প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।
বার্তা কি?
“অপহরণের নাটক”—এই শব্দবন্ধ এখন আলোচিত মুফতি মুহিব্বুল্লাহর জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
তবে এই ঘটনাটি সমাজে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে—সত্য কখনোই লুকিয়ে রাখা যায় না,
বিশেষ করে যখন প্রযুক্তি ও তদন্ত একসাথে কাজ করে।
গাজীপুর পুলিশের এ ঘটনার দ্রুত উন্মোচন প্রমাণ করেছে—
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুধু অপরাধী ধরতে নয়,
অপপ্রচার আর নাটকও ভেদ করতে সক্ষম।
