প্রফেসর ইউনুসের পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে করমর্দনের ছবিতে উঠে এসেছে এক গভীর কূটনৈতিক বার্তা— যেখানে সৌজন্যের আড়ালে প্রতিফলিত হয়েছে শ্রদ্ধা ও প্রভুত্বের তফাৎ।
দুটো ছবির দিকে একবার গভীরভাবে তাকালেই পার্থক্যটা চোখে পড়ে যায়। একটিতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকার এক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে করমর্দন করছেন— যেখানে সৌজন্য, শিষ্টাচার ও কূটনৈতিক মর্যাদার নিখুঁত প্রতিফলন। কর্মকর্তাটি বিনম্র ভঙ্গিতে ক্যাপ হাতে ধরে রেখেছেন, মুখে রয়েছে সম্মানসূচক হাসি। এটা কেবল কূটনৈতিক প্রটোকল নয়, বরং বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। অন্যদিকে, আরেকটি ছবিতে দেখা যায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী এক সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে করমর্দন করছেন।
কিন্তু দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সেখানে জেনারেলের হাতে রয়েছে অহংকারের প্রতীকস্বরূপ একটি ছড়ি, মাথায় অটলভাবে রাখা ক্যাপ— যেন করমর্দনের আড়ালেও ফুটে উঠেছে ক্ষমতার অহমিকা।
ভঙ্গিটা যেন বলছে, “আমরা প্রভু, তোমরা অনুগত।”
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নিয়মে কোনো সামরিক কর্মকর্তা যখন রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন তাঁর হাতে স্টিক বা ‘ব্যাটন অফ কমান্ড’ রাখা অনুচিত।
এটি ক্ষমতার প্রতীক, যা কেবল সামরিক কুচকাওয়াজ বা বাহিনী পরিদর্শনের সময়ই ব্যবহার করা হয়।
রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের সামনে এটি বহন করা শিষ্টাচারবিরুদ্ধ এবং ক্ষমতার অসমতার ইঙ্গিতবাহী।
ইতিহাসে এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
ব্রিটিশ জেনারেল স্যান্ডার্স নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে স্টিক বহন করেননি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিংবদন্তি জেনারেল আইজেনহাওয়ারও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ছিলেন সম্পূর্ণ প্রটোকল মেনে।
এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের জেনারেলরাও দুর্বল রাষ্ট্রের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতে কূটনৈতিক সৌজন্য বজায় রাখতেন।
সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ— ১৯৭২ সালে ভারতীয় জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন,
তখনও তাঁর হাতে ছিল না কোনো ছড়ি, মাথায় ছিল না টুপি— কেবল ছিল এক অনাবিল শ্রদ্ধা ও মমতার প্রতিচ্ছবি।
ইউনুস-জেনারেল সাক্ষাৎ: প্রতীকের পাঠ
প্রফেসর ইউনুস ও পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তার ছবিটি তাই নিছক সৌজন্য বিনিময় নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে এক কূটনৈতিক বার্তা।
যেখানে একপাশে রয়েছে সামরিক অহংকার, অন্যপাশে নোবেলজয়ীর নিরব সম্মতি।
এমন দৃশ্য বাংলাদেশের মানুষের মনে প্রশ্ন তোলে— শান্তির দূত যদি ক্ষমতার প্রতীকের সামনে বিনীত হয়ে দাঁড়ান, তবে তিনি আসলে কার পক্ষে?
কূটনীতিতে প্রতীক কখনও নিরপেক্ষ হয় না।
একটি টুপি পরা, একটি ছড়ি ধরা, বা একটি দৃষ্টি নিচু করা— এগুলোই প্রকাশ করে শক্তি ও শ্রদ্ধার ভারসাম্য কোথায়।
ইতিহাসের এমন প্রেক্ষাপটে যদি আলফ্রেড নোবেল আজ জীবিত থাকতেন, হয়তো তিনি নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত পুরস্কারটির এমন অপব্যবহার দেখে ক্ষুব্ধ হতেন।
হয়তো তিনি শান্তির নামে প্রভুত্বের প্রতীক বয়ে বেড়ানো এই ব্যক্তির হাত থেকে নিজের পুরস্কারটি “জুতার আঘাতে” ফিরিয়ে নিতে চাইতেন।
