২৪-এর দাঙ্গার পর যে ‘সংস্কার পরিকল্পনা’ প্রকাশ পাচ্ছে, তা ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি দমনযজ্ঞের ভয়ংকর প্রতিচ্ছবি। প্রশাসন, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি ধ্বংসের সেই নীলনকশা বিশ্লেষণ করছে এই কলাম।
২৪ সালের দাঙ্গার পর বাংলাদেশের রাজনীতির অন্তরালে যে তথাকথিত ‘সংস্কার পরিকল্পনা’ ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে, তা নিছক প্রশাসনিক পুনর্গঠন নয়—বরং এক ভয়াবহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের নীলনকশা। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে ধ্বংস করে এমন এক রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা, যার শেকড় ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি সামরিক শাসনের আদলে গড়ে উঠেছিল।
তথ্য অনুসারে, সংস্কারের প্রাথমিক খসড়ায় প্রশাসনিক দায়িত্ব নেবে জামায়াতপন্থী আমলাতন্ত্র, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে পাকিস্তানি সামরিক উপদেষ্টা ও তাদের অনুসারীরা,
আর ছাত্র সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করা হবে মিলিশিয়া বাহিনী তৈরির কাজে।
এ পরিকল্পনার রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতেন এক মার্কিন প্রবাসী ব্যক্তি, যার মানসিক ভারসাম্য ও রাজনৈতিক দর্শন উভয়ই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
তাঁর মাধ্যমে রচিত সংবিধানটি তৈরি হতো এমন এক রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে, যেখানে বাঙালি সংস্কৃতি, ভাষা, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শও ‘রাষ্ট্রবিরোধী উপাদান’ হিসেবে গণ্য হতো।
সংস্কারের পেছনের মূল অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল—রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক লুটপাটকে প্রাতিষ্ঠানিক করা।
সিভিল প্রশাসন ভেঙে পড়লে যে শূন্যতা তৈরি হয়, তা পূরণ করতো জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ী চক্র।
বিদেশি ডলার প্রবাহ, দখল করা সরকারি সম্পদ ও কালোবাজারের অর্থই হতো নতুন অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।
এই অর্থনৈতিক মডেলটি ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অবিকল মিলে যায়, যেখানে ধ্বংস, লুট ও বৈষম্যের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হতো।
১৯৭১: ‘রক্তাক্ত পদ্মা’র প্রতিচ্ছবি
এই প্রেক্ষাপটে স্মরণ করা জরুরি আনোয়ার শাহিদ খানের স্মৃতিকথা “পদ্মা সুরখায়”।
১৯৭১ সালে রাজশাহীতে আশ্রিত এই পশ্চিম পাকিস্তানি ছাত্র তার চোখে দেখেছিলেন লুটপাট, দুর্ভিক্ষ, অমানবিকতা ও বাঙালি বণিকশ্রেণির নিশ্চিহ্নতা।
তিনি লিখেছিলেন:
“আজকাল বাজার বসছে ফুটপাথে। আগের লাখপতিরা এখন ডাল বিক্রি করছে। লুঠ করা মাল বিক্রি হচ্ছে খোলাখুলি। সারা বাজারে বাঙালি দোকানদার একজনও নেই।”
এই বিবরণ শুধু ইতিহাস নয়—এ এক ভয়ংকর সতর্কবার্তা।
আজকের বাংলাদেশে প্রশাসনিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার যে ছায়া দেখা যাচ্ছে, তা যেন সেই অতীতের পুনরাবৃত্তি।
যেভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ‘বাংলাদেশ সমস্যা’ সমাধানের নামে বাঙালি জনগোষ্ঠীর গণহত্যা চালিয়েছিল,
তেমনি ২৪-এর দাঙ্গার পর ‘সংস্কার’ নামে চালানো এই পরিকল্পনাও একই মিশনকে সামনে রাখে—জাতিসত্তা বিনাশ ও সাংস্কৃতিক পুনর্লিখন।
যদি এই পরিকল্পনা সফল হতো, তাহলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচয় মুছে গিয়ে তা পরিণত হতো এক ধর্মীয় সন্ত্রাসনির্ভর অখণ্ড শাসনযন্ত্রে।
৭১-এর পর ২৪-এর ছকও আমাদের মনে করিয়ে দেয়—যখন জাতির সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে টার্গেট করা হয়, তখন সেটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক লড়াই নয়; এটি অস্তিত্বের লড়াই।
ইতিহাসের ভয়ংকর পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক সচেতনতা, সাংস্কৃতিক আত্মরক্ষা এবং সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ।
২৪-এর দাঙ্গার পর ‘সংস্কার’ নামে যা ঘটছে, তা আসলে ১৯৭১ সালের দখলদার পাকিস্তানি নীলনকশারই আধুনিক সংস্করণ।
পার্থক্য শুধু মাধ্যম ও মুখোশে—লক্ষ্য একটাই, বাঙালিত্ব মুছে ফেলা।
ইতিহাস জানলে এই ষড়যন্ত্র রোধ করা সম্ভব, না জানলে তার পুনরাবৃত্তিই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ।
