রয়টার্সকে দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে কোটি সমর্থক ভোট বয়কট করবে।
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা – যিনি ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্রনেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের পর দেশ ত্যাগে বাধ্য হন, এবার প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নির্বাচন, বিচার ও নিজের দেশে ফেরার প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা ইমেইলের মাধ্যমে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে বলেছেন — “আওয়ামী লীগকে যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া হয়, তাহলে লাখ লাখ সমর্থক ভোট বয়কট করবে।”
এই সাক্ষাৎকারটি তাঁর ১৫ বছরের টানা শাসন শেষে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো কোনো আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া বক্তব্য, যা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
নির্বাচন ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বক্তব্য;
শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আয়োজিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণের সুযোগ না দিলে সেই নির্বাচন বৈধতা হারাবে। তাঁর ভাষায়,
“একটি কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাইলে কোটি কোটি মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না।”
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুধু অন্যায্য নয়, বরং “আত্মঘাতী” সিদ্ধান্ত।
বর্তমানে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন স্থগিত করেছে, এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
তবুও শেখ হাসিনা এখনো আশাবাদী যে “শুভবুদ্ধির উদয় হবে” এবং আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে।
বিচার ও মানবতাবিরোধী অভিযোগ প্রসঙ্গে;
রয়টার্সকে শেখ হাসিনা জানান, তাঁর বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
তিনি বলেন,
“এটি একটি ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’, যেখানে আগেই রায় নির্ধারিত ছিল। আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেওয়া হয়নি।”
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় সংঘটিত সহিংসতায় জাতিসংঘের তথ্যমতে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হয়েছিলেন।
তবে শেখ হাসিনা এই সংখ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলেন, তাঁর সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী কোনোভাবেই গণহত্যা চালায়নি এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের কোনো নির্দেশ তিনিও দেননি।
ভারতে নির্বাসন ও ব্যক্তিগত জীবন;
রয়টার্স প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা বর্তমানে দিল্লিতে “স্বাধীনভাবে” বসবাস করছেন। তাকে মাঝে মাঝে শহরের লোধি গার্ডেনে হাঁটতে দেখা যায়, যদিও তিনি অতীতের ভয়ংকর পারিবারিক ইতিহাসের কারণে সতর্ক থাকেন।
১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য নিহত হন।
সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকেই তিনি সর্বদা নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থাকেন।
দেশে ফেরার প্রশ্নে দ্ব্যর্থহীন উত্তর;
শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, তিনি বর্তমান সরকারের আমলে দেশে ফিরবেন না।
তিনি বলেন,
“যে সরকার নির্বাচনী বৈধতা অর্জন করবে না, তার সময় আমি দেশে ফিরব না।”
তবে তিনি আবারও ইঙ্গিত দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে পুনরায় সংগঠিত হবে এবং দেশে ফেরার পর জাতির সেবা করবে—তা সরকারে হোক বা বিরোধী দলে।
রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও নেতৃত্ব প্রসঙ্গ;
নিজে বা তাঁর পরিবারের কেউ ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেবেন কি না, এই প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেছেন—
“এটা আমার বা আমার পরিবারের ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে জনগণ ও সাংবিধানিক শাসন।”
তিনি যোগ করেন,
“আমরা যা চাই—একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা পরিবার নয়, রাষ্ট্রই হবে সর্বোচ্চ।
সাক্ষাৎকারের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তাৎপর্য;
- আন্তর্জাতিক উপস্থিতি পুনর্গঠন: দীর্ঘ নীরবতার পর শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকার তাঁর রাজনৈতিক পুনরাবির্ভাবের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
- ড. ইউনূস প্রশাসনের জন্য চাপ: তাঁর মন্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা ও মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলতে পারে।
- আওয়ামী লীগের পুনরায় সক্রিয়তা: নিষিদ্ধ দলের নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার বক্তব্য তাঁর সমর্থকদের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করতে পারে।
- ভারতের ভূমিকাও আলোচনায়: তিনি দিল্লিতে অবস্থান করায় প্রতিবেশী ভারতের রাজনৈতিক অবস্থানও নতুন করে মূল্যায়নের মুখে পড়েছে।
ফলাফল;
শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকার শুধু একটি সংবাদ নয়—এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির নতুন অধ্যায়।
তিনি হয়তো বর্তমানে নির্বাসনে, কিন্তু তাঁর বক্তব্য প্রমাণ করছে—তিনি এখনো রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, তা নির্ধারণ করবে আগামী দিনের বাংলাদেশ—
কিন্তু একথা নিশ্চিত যে, শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকার আবারও আন্তর্জাতিক মহলের চোখ ফেরালো ঢাকামুখী।
সারসংক্ষেপে:
- আওয়ামী লীগ বাদে নির্বাচনে অংশগ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা করলেন শেখ হাসিনা।
- মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ‘রাজনৈতিক নাটক’ বলে উড়িয়ে দিলেন।
- দেশে ফেরার কোনো পরিকল্পনা নেই—বর্তমান সরকারের বৈধতা না আসা পর্যন্ত ।
- তাঁর বক্তব্যে ইঙ্গিত: “বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষায় আওয়ামী লীগ ফিরবে—সেটাই সময়ের দাবি।”
