 
                  সিলেটের জাফলং, বিছনাকান্দি ও সাদাপাথরে অবৈধ পাথর লুটপাট অগাস্ট-পরবর্তী সময়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিএনপি নেতাদের নেতৃত্বে পরিচালিত সিন্ডিকেটের কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটন শিল্প ধ্বংসের মুখে।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী জেলা সিলেট শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই নয়, পর্যটন ও খনিজ সম্পদের জন্যও বিশ্বজুড়ে পরিচিত। ‘প্রকৃতিকন্যা’ জাফলং, বিছনাকান্দি কিংবা সাদাপাথর—এই সব স্থান শুধু দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণই নয়, বরং দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর এই অঞ্চলগুলিতে নেমে আসে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ, যেখানে অবৈধ পাথর উত্তোলন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটের নেপথ্যে উঠে এসেছে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাদের নাম।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শিথিল হয়ে গেলে পাথরখেকো সিন্ডিকেটগুলো যেন মুক্তির স্বাদ পায়।
স্থানীয় সূত্র মতে,
ওই দিন থেকেই গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের একাধিক কোয়ারি থেকে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি মূল্যের পাথর ও বালু লুট করা হয়।
সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাফলং, বিছনাকান্দি, সাদাপাথর, ভোলাগঞ্জ ও শারফিন টিলা—যেগুলো কেবল প্রাকৃতিক নিদর্শনই নয়, দেশের পর্যটন অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ।
যদিও জেলা প্রশাসন অবৈধ ৩০০ ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে, বাস্তবে লুটপাট থামেনি।
এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সফরের পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
বরং কোয়ারি বন্ধের প্রতিবাদে অভিযুক্তদের মিছিল ও গাড়িবহর অবরোধের ঘটনা প্রমাণ করেছে, প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব কতটা গভীর।
সবচেয়ে ভয়াবহ অভিযোগ এসেছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে।
স্থানীয়দের দাবি,
৫ আগস্টের পর তিনি ও তার সহযোগীরা সাদাপাথর, বাংকার এলাকা, নির্মাণাধীন স্থলবন্দর এবং শারফিন টিলা দখলে নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে লুট চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই সিন্ডিকেটে যুবদল ও শ্রমিক দলের নেতারাও যুক্ত।
শুধু পাথরই নয়, রেলওয়ের মূল্যবান যন্ত্রাংশসহ প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ লুট হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ECA) হিসেবে ঘোষিত জাফলংয়ে এই লুটপাটের প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী,
গত বছরের জুলাই পর্যন্ত এখানে ৩ কোটি ৭৪ লাখ ঘনফুট পাথর মজুত ছিল।
লুটের পর প্রায় ১ কোটি ঘনফুট পাথর উধাও হয়ে গেছে, যার বাজারমূল্য শতকোটি টাকার বেশি।
বিছনাকান্দি থেকেও প্রায় ৬০ লাখ ঘনফুট পাথর চুরির অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু জব্দকৃত পাথরের কোনো হদিস মেলেনি।
এই অবাধ লুটপাট শুধু সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করছে না, বরং দেশের পর্যটন ও পরিবেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করছে।
স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা সতর্ক করেছেন—যদি দ্রুত এই সিন্ডিকেট ভেঙে না দেওয়া হয়, তবে সাদাপাথর, জাফলং ও বিছনাকান্দি কেবল ইতিহাসের পাতায় নাম হিসেবে বেঁচে থাকবে।
এই ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্ট করে যে,
রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা মিলে কীভাবে একটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটন সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোর এই দুর্দশা থামাতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক কঠোরতা এবং স্থানীয়দের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

 
                         
         
         
        