সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু ও শেষ লেখায় উঠে এসেছে জীবনের হতাশা, সাংবাদিকতার অনিশ্চয়তা এবং সমাজের নীরব ব্যর্থতা। বিস্তারিত বিশ্লেষণ পড়ুন।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির নাম হয়ে গেলেন বিভুরঞ্জন সরকার। একদিন নিখোঁজ থাকার পর মুন্সিগঞ্জের মেঘনা নদীতে ভাসমান লাশ হিসেবে তার ফিরে আসা আমাদের শুধু হতবাকই করেনি, বরং সাংবাদিকতার ভেতরের অস্থিরতা, চাপ ও অস্বীকৃত সাফল্যের কাহিনীকে নগ্নভাবে সামনে এনেছে।
তার শেষ লেখা—যেটি তিনি নিজেই “খোলা চিঠি” হিসেবে স্থানীয় একটি গণমাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন—ছিল বেদনার্ত আত্মসমালোচনা।
তিনি লিখেছিলেন:
“আমার জীবনে কোনো সাফল্যের গল্প নেই।
সাংবাদিক হিসেবেও এ-ডাল ও-ডাল করে কোনো শক্ত ডাল ধরতে পারিনি।
আমার কোথাও না কোথাও বড় ঘাটতি আছে।
এই ঘাটতি আর কাটিয়ে ওঠা হলো না।
দুঃখই হোক আমার জীবনের শেষ সঙ্গী। আর পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক।”
ফুটনোটে তিনি যুক্ত করেছিলেন—“জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন।”
অর্থাৎ এটি কেবল ব্যক্তিগত এক দুঃখকথা নয়, বরং বিদায় বার্তা।
তার খোলা চিঠির একটি অংশ পাঠক দের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি বরং এই অংশেই আত্নহননের প্রধান কারন নিহিত আর তা হলো লেখকের কলমের পূর্ন স্বাধীনতা হরন।
খোলা চিঠির সেই অংশ টি হুবুহ তুলে ধরা হল—
“এর মধ্যে গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর গণমাধ্যমের অবস্থা আরও কাহিল হয়েছে। মন খুলে সমালোচনা করার কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। কিন্তু তার প্রেস বিভাগ তো মনখোলা নয়।
মিডিয়ার যারা নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন তারা সবাই আতঙ্কে থাকেন সব সময়।
কখন না কোন খবর বা লেখার জন্য ফোন আসে।
তুলে নিতে হয় লেখা বা খবর!
এর মধ্যে আমার একটি লেখার জন্য ‘আজকের পত্রিকা’র অনলাইন বিভাগকে লালচোখ দেখানো হয়েছে।
মাজহারুল ইসলাম বাবলার একটি লেখার জন্যও চোটপাট করা হয়েছে।
আপত্তিকর কি লিখেছেন বাবলা?
লিখেছেন, সেনাবাহিনী শেখ হাসিনাকে সামরিক হেলিকপ্টারে দিল্লি পাঠিয়েছে।
আর শুধু পুলিশের গুলিতে নয়, মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে জঙ্গিরাও মানুষ হত্যা করেছে।
এখানে অসত্য তথ্য কোথায়?
শেখ হাসিনা কি হেলিকপ্টার ভাড়া করে গোপনে পালিয়েছেন?
হাসিনার পুলিশ না হয় ছাত্র জনতাকে হত্যা করলো কিন্তু পুলিশ হত্যা করলো কে বা কারা?
এইটুকু লেখার জন্য পত্রিকার বিরুদ্ধে তোপ দাগা একেবারেই অনুচিত।
সব মিলিয়ে পত্রিকায় আমার অবস্থা তাই খুবই নাজুক।
সজ্জন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক চাপ সইতে না পেরে আমার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করেছেন।
আমি এখন কী করি?
কোন পথে হাঁটি?”
পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে তিনি অফিসে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন।
এরপর আর ফেরেননি। রাতে না ফেরায় তার ছেলে ঋত সরকার রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
পরদিন বিকেলে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার বলাকির চর এলাকায় মেঘনা নদীতে ভাসমান অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করে নৌপুলিশ।
ছবির সঙ্গে মিলিয়ে পরিবারের কাছে খবর দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে পরিবার আনুষ্ঠানিকভাবে মরদেহ শনাক্ত করে।
বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিক আজ নানা ধরনের আর্থিক অনিশ্চয়তা, চাপ ও অস্বীকৃতিতে ভুগছেন।
অনেকের জীবনে নেই স্থিতিশীল আয়ের নিশ্চয়তা, নেই সামাজিক নিরাপত্তা, আবার নেই সম্মানজনক স্বীকৃতি।
বিভুরঞ্জন সরকারের আত্মদহন কি সেই অপ্রকাশিত বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি নয়?
তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রশ্ন উঠছে—
সাংবাদিকতার মতো পেশায় টিকে থাকা কি ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে?
যাদের কলম সত্য উচ্চারণ করে, তাদের জীবন কেন এতটা অনিরাপদ ও অনিশ্চিত?
রাষ্ট্র ও সমাজ সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি কেন উপেক্ষা করে?
মৃত্যুর পর পোস্টমর্টেম শেষে মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।
পরিবারের জন্য এটি এক অসহনীয় ক্ষতি, তবে বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজের জন্যও এটি এক অস্বস্তিকর আত্মসমালোচনার মুহূর্ত।
বিভুরঞ্জন সরকারের শেষ লেখা যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় আমাদের দিকেই—
সাংবাদিকদের জন্য আমরা আসলে কী করি?
তারা কি শুধুই সমাজের খবর লিখবেন, অথচ নিজেরা অগোচরে ভেঙে পড়বেন?

সাংবাদিকতার মতো পেশায় টিকে থাকা কি ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে?
যাদের কলম সত্য উচ্চারণ করে, তাদের জীবন কেন এতটা অনিরাপদ ও অনিশ্চিত? … দাদাকে প্রথম পাই যায়যায়দিনে, পরে ভোরের কাগজে/ চলতিপত্র/ প্রথম আলোসহ আরও অনেক পত্রিকায়….. সাহসী কলামের অনুরাগী ছিলাম সেই প্রথম থেকেই….. দাদা তোমায় সালাম, এই বিষের সমাজে তোমাকে বাঁচতে দিতে না পারার অক্ষমতা পোড়াবে আজীবন …….. 😥😥😥