অর্থনৈতিক সংকটে যখন লাখো মানুষ চাকরি হারাচ্ছে ও দারিদ্র্য বাড়ছে, তখন মাত্র ৮–১০ মাসে বাংলাদেশে নতুন কোটিপতি হয়েছেন ১০ হাজারেরও বেশি। এ প্রবণতার পেছনে কী রহস্য?
বাংলাদেশের অর্থনীতি এক ভয়াবহ মন্দার মধ্যে রয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩.৯৭ শতাংশে—যা কোভিড-পরবর্তী সময়ে সর্বনিম্ন। বেকারত্বের হার বেড়ে গেছে ৮ শতাংশের ওপরে, দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮%। শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, ২৬ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে, বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় শূন্য। অথচ এমন সংকটের ভেতরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য জানাচ্ছে, গত ৮–১০ মাসে নতুন করে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ কোটিপতি হয়েছেন।
এটি নিছক কাকতালীয় নয়।
বরং, অর্থনীতির ভেতরে অস্বচ্ছ প্রবাহ এবং অসমতা বাড়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে—
কারা এই নতুন কোটিপতিরা, কীভাবে তারা অস্বাভাবিকভাবে সম্পদশালী হয়ে উঠছে, যখন সাধারণ মানুষ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের Banking Statistics Report অনুযায়ী:
- সেপ্টেম্বর ২০২৪: কোটিপতি অ্যাকাউন্ট ছিল ১ লাখ ১৭ হাজার ১২৭টি
- ডিসেম্বর ২০২৪: বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ২২ হাজার ৮১টি
- মার্চ ২০২৫: আবারও বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ২১ হাজার ৩৬২টি
- জুন ২০২৫: চমকপ্রদভাবে পৌঁছায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩৬টিতে
অর্থাৎ, গত তিন মাসেই ৫,৯৭৪টি নতুন কোটিপতি অ্যাকাউন্ট যুক্ত হয়েছে, আর গত ৮–১০ মাসে যোগ হয়েছে ১০,৯২৮টি।
এখানে আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো—৮৭% নতুন কোটিপতির বয়স ৩০ বছরের কম, এমনকি প্রায় ২ হাজার কোটিপতি এখনও পড়াশোনা শেষও করেননি।
মাত্র এক বছর আগে তাদের বার্ষিক লেনদেন ছিল ২–২.৫ লাখ টাকা, অথচ এখন মাসিক লেনদেন দাঁড়িয়েছে ৩০–৩৫ লাখ টাকায়।
অর্থনীতিবিদরা কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ দেখাচ্ছেন—
জুলাই ২০২৪ আন্দোলনের পর অনেক ধনী ব্যক্তি বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে এনেছেন।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রেমিট্যান্স কিছুটা বেড়েছে, তবে শ্রমজীবী পরিবারগুলো সেই অর্থ খরচ করেই ফেলে, সঞ্চয় কম থাকে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, লন্ডারিংকৃত অর্থ কিংবা অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ব্যাংক খাতে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট বাড়াচ্ছে।
নন-পারফর্মিং লোনের হার ২৫% ছাড়িয়ে যাওয়া এবং ২৫টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি এই সন্দেহ আরও ঘনীভূত করছে।
অর্থনৈতিক সংকটে সাধারণ মানুষ হাহাকার করছে—চাকরি হারাচ্ছে, দারিদ্র্যে ডুবে যাচ্ছে।
অথচ অল্প বয়সে কয়েক হাজার তরুণ কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে।
এই বৈপরীত্য একটি বিষয় স্পষ্ট করে: বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অতি অসমতল ও অস্বচ্ছ হয়ে পড়েছে।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন:
“অর্থনৈতিক সংকটে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়ছে, কিন্তু কোটিপতি অ্যাকাউন্ট বাড়ছে কীভাবে? এটি অর্থনৈতিক অসমতার গভীরতা প্রকাশ করছে। সরকারকে এখনই ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা আনার পদক্ষেপ নিতে হবে।”
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা একটি দ্বিমুখী সংকটের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে—
- একদিকে জনগণের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য ও বেকারত্ব
- অন্যদিকে হঠাৎ অস্বাভাবিক কোটিপতি সৃষ্টি
যদি অবৈধ উৎস থেকে এই সম্পদশালী শ্রেণি গড়ে ওঠে, তবে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে পড়বে।
এখন সরকারের জন্য জরুরি—স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করা, আর অবৈধ অর্থপ্রবাহ বন্ধ করা। না হলে কিছু মানুষের সোনার ঘর উঠলেও সাধারণ মানুষ অন্ধকারেই থেকে যাবে।
