ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের ১৮ টন রুশ সরঞ্জাম পুড়ে ছাই। কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি ও প্রকল্পে সম্ভাব্য বিলম্বে দেশীয় বাণিজ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে।
রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাশিয়া থেকে আনা প্রায় ১৮ টন গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। ঘটনাটি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়—এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্পের সময়সূচি, নিরাপত্তা মান এবং আন্তর্জাতিক আস্থার ওপর গভীর প্রশ্ন তুলেছে।
রূপপুর প্রকল্পের এই অংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিউক্লিয়ার ফিউেল হ্যান্ডলিং সিস্টেমের উপাদান, যা কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের জন্য রোস্যাটম কর্পোরেশন থেকে আমদানি করা হয়েছিল।
যদিও এগুলো তেজস্ক্রিয় নয়, তবুও প্রকল্পের নিরাপত্তা ও রিয়্যাক্টর ব্যবস্থাপনার জন্য তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
দুপুর সোয়া ২টার দিকে শুরু হওয়া আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে কার্গো ভিলেজের একাধিক গুদামে।
ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও বিজিবির প্লাটুন মিলে প্রায় ৬ ঘণ্টার লড়াই শেষে রাত ৮টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক এম কে জাকির হাসান স্বীকার করেন, “কার্গো এলাকায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা ছিল।”
যদিও তিনি নাশকতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন, তবুও অগ্নিকাণ্ডের ধরণ ও ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, “এই অগ্নিকাণ্ড শুধু রূপপুর নয়, বরং দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক আস্থায়ও বড় আঘাত।
এখন প্রতিদিন কোটি টাকার পণ্য আটকে যাচ্ছে।”
রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের মোট বিনিয়োগ ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার প্রধান অর্থায়ন রাশিয়া করছে।
প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল ২০২৪ সালের শেষে প্রথম ইউনিট চালু করা এবং ২০২৫-এ দ্বিতীয় ইউনিট কার্যকর করা।
কিন্তু এখন ১৮ টন সরঞ্জাম পুড়ে যাওয়ায় সময়সূচি অনিবার্যভাবে বিলম্বিত হবে।
রোস্যাটমের সঙ্গে জরুরি যোগাযোগ শুরু হয়েছে, তবে নতুন সরঞ্জাম তৈরি, পাঠানো ও পুনঃইনস্টলেশনে সময় ও অতিরিক্ত খরচ দুটোই বাড়বে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন একটি কৌশলগত প্রকল্পে ‘সাপ্লাই চেইন রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’ ব্যর্থ হয়েছে।
তারা মনে করেন, এ ধরনের উচ্চমূল্যের প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম বিমানবন্দরে সাধারণ গুদামে রাখার সিদ্ধান্ত “গুরুতর অব্যবস্থাপনা”।
নিরাপত্তা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন
রূপপুর প্রকল্প শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতীক নয়, বরং এটি বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু এই অগ্নিকাণ্ড দেখিয়ে দিল, নিরাপত্তা মান, কার্গো হ্যান্ডলিং ও সেফটি প্রটোকল কতটা দুর্বল অবস্থায় রয়েছে।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
“যে দেশে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো এলাকায় এমনভাবে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, সে দেশে পারমাণবিক প্রকল্পের সেফটি কালচার নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।”
এছাড়া, সম্প্রতি মিরপুরের রূপনগর, চট্টগ্রাম ইপিজেড ও নারায়ণগঞ্জে ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের প্রেক্ষিতে এটি আরও উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
সরকারি সংস্থা, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও রূপপুর প্রকল্প কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি সমন্বিত সেফটি প্রটোকল গড়ে তোলা এখন জরুরি।
এর মধ্যে থাকা উচিত—
- উচ্চমূল্যের কার্গোর জন্য আলাদা সুরক্ষিত স্টোরেজ জোন,
- রিমোট ফায়ার সাপ্রেশন সিস্টেম ও কন্টিনিউয়াস মনিটরিং,
- এবং আন্তর্জাতিক মানের “ডিজাস্টার রেসপন্স সিমুলেশন”।
রূপপুর প্রকল্পের সফলতা এখন শুধু প্রকৌশলগত নয়—বিশ্ব আস্থার পরীক্ষাও বটে। এই ঘটনায় দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত, দায় নির্ধারণ এবং পুনর্বাসনই সেই আস্থা পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপায়।
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে এই অগ্নিকাণ্ড বাংলাদেশের অবকাঠামো নিরাপত্তা ব্যবস্থার এক নগ্ন প্রতিচ্ছবি।
এটি শুধু কোটি টাকার ক্ষতি নয়—দেশের উন্নয়ন যাত্রায় এক বড় ধাক্কা, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়: উন্নয়ন শুধু নির্মাণে নয়, নিরাপত্তা ও দায়িত্ববোধেও।
