বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের ওপর সংঘটিত সহিংসতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে আইসিসিতে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক আইনজীবী দল।
বাংলাদেশে জুলাই ২০২৪-এ শুরু হওয়া রাজনৈতিক পালাবদল ও সহিংসতার পর আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) আওতায় মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে— এমন দাবি জানিয়ে লন্ডনের আইনজীবী স্টিভেন পাউলস কেসি (Steven Powles KC) হেগে আইসিসি প্রসিকিউটরের কাছে একটি আর্টিকেল ১৫ কমিউনিকেশন (Article 15 Communication) দাখিল করেছেন।
এই আবেদনপত্রে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও দমনমূলক অভিযানের পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ
দাখিলকৃত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে পরিচালিত সহিংসতা,
- গণহত্যা,
- কারাবন্দীকরণ,
- নির্যাতন, এবং
- বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের
বিস্তৃত উদাহরণ পাওয়া গেছে, যা রোম স্ট্যাটিউট অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে পড়ে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে এই অপরাধগুলোর দেশীয় বিচার হওয়ার কোনো বাস্তব সম্ভাবনা নেই। ফলে অপরাধীরা দায়মুক্তি পাচ্ছে।”
সহিংসতার পরিসংখ্যান ও প্রমাণাদি
যোগাযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, জুলাই ২০২৪ থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬০০ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন।
এর মধ্যে অনেকেই জনতার হাতে গণপিটুনির শিকার, এবং তাদের মৃত্যুর ছবি ও ভিডিও আইসিসি প্রসিকিউটরের কাছে পাঠানো হয়েছে।
অন্যদিকে, ১৮ হাজারের বেশি ব্যক্তি “অপারেশন ডেভিল হান্ট” নামের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।
এদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষক, বিচারক ও শিল্পীরা রয়েছেন।
এছাড়া ৪৫ জন আওয়ামী কর্মীর হেফাজতে মৃত্যু এবং অসংখ্য নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ ‘হার্ট অ্যাটাক’ বলা হলেও দেহে নির্যাতনের স্পষ্ট চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ ও দায়মুক্তি অধ্যাদেশ
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তী প্রশাসন ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে একটি অভিযান পরিচালনা করে, যার লক্ষ্য ছিল কথিত “আওয়ামী ফ্যাসিবাদ দমন।”
এই অভিযানের মাধ্যমে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও দমননীতি চালানো হয়।
তবে এর মাত্র আট মাস পর, ১৪ অক্টোবর ২০২৪-এ “দায়মুক্তি আদেশ” জারি করা হয়— যাতে ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো ছাত্র বা নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না।
আইনজীবী স্টিভেন পাউলস কেসি এই পদক্ষেপকে “বিচারহীনতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ” বলে আখ্যা দিয়েছেন।
আইসিসি-এর এখতিয়ার ও বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি
বাংলাদেশ ২০১০ সালের ২৩ মার্চ রোম স্ট্যাটিউট অনুসমর্থন করে এবং সেই বছরের ১ জুন থেকে আইসিসি বিধান কার্যকর হয়।
ফলে, দেশটিতে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে আইসিসি সরাসরি তদন্ত করতে পারে।
যোগাযোগে উল্লেখ করা হয়েছে—
“বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় নিরপেক্ষ তদন্ত সম্ভব নয়। তাই আইসিসির পক্ষ থেকেই এই তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।”
ন্যায়বিচারের দাবি ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব
স্টিভেন পাউলস কেসি বলেন,
“রাজনৈতিক পালাবদলের সময় প্রতিশোধমূলক অপরাধ আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আওতাধীন এবং এর দমন মানবতার স্বার্থে অপরিহার্য।”
আইসিসিতে দাখিলকৃত এই যোগাযোগ এখন প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে পর্যালোচনার অপেক্ষায় আছে।
তদন্ত অনুমোদিত হলে এটি হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক বিচারিক প্রক্রিয়া।
শেষ কথা
বাংলাদেশে ২০২৪-২৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা কেবল অভ্যন্তরীণ নয়—এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামোরও বড় প্রশ্নে পরিণত হয়েছে।
আইসিসি যদি তদন্ত শুরু করে, তবে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক ঐতিহাসিক মোড় আনবে—যেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় থেকে কেউই মুক্ত থাকবে না।
