পাকিস্তানি জেনারেলের হাতে ব্যাটনসহ ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ কূটনৈতিক প্রটোকল ভঙ্গ কিনা তা নিয়ে এখন উত্তাল আলোচনা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় শনিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির (CJCSC) চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা। কিন্তু ওই সাক্ষাতের একটি ছবি এখন কূটনৈতিক মহলে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়—জেনারেল মির্জার বগলে একটি ব্যাটন বা সোয়াগার স্টিক, যা সাধারণত সামরিক অনুষ্ঠানে বহন করা হয়। অথচ, কোনো বেসামরিক সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এমন বস্তু বহন করা আন্তর্জাতিক প্রটোকল অনুযায়ী শিষ্টাচারবহির্ভূত।
সোয়াগার স্টিক: ক্ষমতা ও সামরিক প্রতীক
সামরিক পরিভাষায় সোয়াগার স্টিক হলো এক ধরনের কর্তৃত্বের প্রতীক। ঐতিহাসিকভাবে সেনা কর্মকর্তারা কুচকাওয়াজ, পরিদর্শন বা ড্রিলের সময় এটি ব্যবহার করেন।
এটি মূলত নির্দেশনা, দূরত্ব নির্ধারণ ও নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
তবে আধুনিক কূটনৈতিক প্রথায় কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতে এটি বহন করা অনুচিত হিসেবে ধরা হয়।
কারণ, সামরিক পদমর্যাদা কূটনৈতিক মর্যাদার ঊর্ধ্বে নয়।
বেশ কিছু আন্তর্জাতিক নজিরে দেখা গেছে—ব্রিটিশ, আমেরিকান ও ভারতীয় জেনারেলরা কখনও কোনো বিদেশি রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সোয়াগার স্টিক বহন করেননি।




বাংলাদেশের আইন কী বলছে
বাংলাদেশের প্রচলিত নিরাপত্তা প্রোটোকল অনুযায়ী, প্রধান উপদেষ্টা বা সরকারপ্রধানের উপস্থিত স্থানে কেউ ব্যাটন, লাঠি বা অস্ত্রসদৃশ কোনো বস্তু নিয়ে প্রবেশ করতে পারেন না।
এসএসএফ বা বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী এ বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক থাকে।
এমনকি ব্যাটনকেও “প্রতিরক্ষামূলক বা আক্রমণাত্মক সরঞ্জাম” হিসেবে ধরা হয়।
অতএব, কোনো বিদেশি সামরিক কর্মকর্তার ব্যাটনসহ উপস্থিতি শুধু প্রটোকল ভঙ্গ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিধিরও ব্যতিক্রম।
রাজনৈতিক প্রতীক ও প্রটোকল ভঙ্গের চিত্র
প্রকাশিত গ্রুপ ছবিতে দেখা যায়, প্রটোকল অনুসারে প্রধান উপদেষ্টা মাঝখানে দাঁড়ালেও দুই পাশে প্রতিনিধিদের অসম বিন্যাস রয়েছে—বামে ৬ জন, ডানে ৪ জন।
তারওপর, কেবল পাকিস্তানি জেনারেলের হাতেই দেখা গেছে সোয়াগার স্টিক।
দৃশ্যত এমন এক বার্তা ফুটে উঠেছে যেন বৈঠকের কেন্দ্রবিন্দুতে সামরিক নেতৃত্বই প্রাধান্য পাচ্ছে।
ফলে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি এক ধরনের “শারীরিক প্রতীকী বার্তা”—যা কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ইঙ্গিত বহন করে।
বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক হাসান মোর্শেদ মন্তব্য করেন—
“কোনো সামরিক কর্মকর্তা যখন অন্য রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন সোয়াগার স্টিক বহন করা কূটনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। কারণ তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের সমকক্ষ নন; অথচ স্টিক বহনের মাধ্যমে তিনি অথরিটি প্রতীক প্রদর্শন করছেন।”
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন—
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন জেনারেল আইজেনহাওয়ারও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সঙ্গে সাক্ষাতে স্টিক ব্যবহার করেননি। এমনকি ভারতের জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রটোকল মেনে চলেছিলেন।”
কূটনৈতিক বার্তা নাকি মনস্তাত্ত্বিক ইঙ্গিত?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের এই আচরণ শুধুমাত্র প্রটোকল ভঙ্গ নয়—বরং একটি মনস্তাত্ত্বিক সংকেতও বটে।
যে সংকেত হয়তো বোঝাতে চায়— বর্তমান বাংলাদেশ সরকার বা তার নেতৃত্ব পাকিস্তানি সামরিক নেতৃত্বের অধীন কূটনৈতিক ছায়ায় আছে।
এমন ধারণা আরও দৃঢ় হচ্ছে কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে ইউনূস সরকারের সময় পাকিস্তানি ধর্মীয় বক্তা ও জেনারেলদের ঘন ঘন আগমন লক্ষ করা যাচ্ছে।
শেষ কথা;
সামরিক প্রতীক বহন করে বেসামরিক নেতৃত্বের সামনে হাজির হওয়া কোনো সাধারণ ভুল নয়, বরং এটি কূটনৈতিকভাবে একটি গভীর বার্তা বহন করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও পাকিস্তানের ভূমিকার প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা কেবল প্রোটোকল লঙ্ঘন নয়—বরং জাতীয় মর্যাদা ও স্বাধীন কূটনীতির প্রশ্নও উত্থাপন করেছে।
