 
                  ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুটি পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে এক কর্মী নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছেন। এই সংঘর্ষ দলটির অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও গ্রামীণ রাজনীতির জটিলতা তুলে ধরেছে।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার জামাল ইউনিয়নের নাকোবাড়িয়া ও তালিয়ান গ্রামে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মোহাব্বত আলী (৬০) নামের এক কর্মী নিহত হওয়া কেবল একটি ‘সংঘর্ষের’ খবর নয়, এটি মূলত দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ বিভাজনের ভয়াবহতা এবং স্থানীয় রাজনীতিতে চরম সহিংসতার বহিঃপ্রকাশ।
রোববার ভোর থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত চলা দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত হয়েছেন আরও অন্তত পাঁচজন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
গ্রামীণ রাজনীতির মাঠে এই রক্তপাতের ঘটনা শুধু একটি ইউনিয়ন বা দুটি গ্রামের মাঝে উত্তেজনার বিষয় নয়, এটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি—যেখানে আদর্শ নয়, আধিপত্যই মুখ্য হয়ে উঠেছে।
প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি দুই গ্রামের স্থানীয় আধিপত্যের দ্বন্দ্ব বলে মনে হলেও, খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে এর গভীরে রয়েছে দীর্ঘদিনের দলীয় নেতৃত্বহীনতা, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে ধারাবাহিক রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও নজরদারির অভাব।
৫ আগস্টের পর এই দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, যা অবশেষে একটি পরিকল্পিত সহিংসতায় রূপ নেয়।
শনিবার এক পক্ষের লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়ার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এবং তার পরদিনই সংঘর্ষ—এই ধারাবাহিকতা থেকে পরিষ্কার, সংঘর্ষটি আকস্মিক ছিল না, বরং একটি সুপরিকল্পিত হামলার অংশ।
প্রশ্ন জাগে, সংঘর্ষের আগে স্থানীয় বিএনপির নেতৃত্ব কী করছিল? দীর্ঘদিনের বিরোধ থাকা সত্ত্বেও কেন কেন্দ্রীয় বা জেলা পর্যায়ের নেতারা হস্তক্ষেপ করেননি?
স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে আদর্শিক বন্ধন বা রাজনৈতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে না পারার দায় এড়াতে পারেন না দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব।
এ ধরনের সংঘর্ষ দলের ভাবমূর্তি ও জনসমর্থনের জন্য আত্মঘাতী। দলীয় সহকর্মী হত্যার দায় দলীয় কাঠামোর ভেতরেই বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। একজন কর্মীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুধু একটি জীবন ঝরে যায় না, ভেঙে পড়ে একটি রাজনৈতিক শক্তির বিশ্বাসযোগ্যতাও।
সংঘর্ষের সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ উপস্থিতি পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনলেও, এর আগে কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হস্তক্ষেপ করেনি, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে সহিংসতার ভিডিও ছড়িয়ে পড়া সত্ত্বেও সংঘর্ষ ঠেকানো সম্ভব হয়নি, যা স্থানীয় প্রশাসনের প্রস্তুতির ঘাটতিও নির্দেশ করে।
ওসি শহিদুল ইসলাম হাওলাদার জানান, “পরিস্থিতি এখনো উত্তপ্ত।” তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এমন সংঘর্ষ কেবল আইনশৃঙ্খলার ইস্যু নয়—এটি রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ব্যর্থতাও।
কালীগঞ্জের এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন তোলে—বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী আদর্শের চেয়ে আধিপত্য বড় হয়ে উঠছে?
বিএনপির মতো জাতীয় পর্যায়ের একটি দলের কর্মীরা যদি নিজেদের মধ্যেই সংঘর্ষে জড়ায়, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে তারা কী বার্তা দিচ্ছেন?
এই ঘটনা প্রমাণ করে, নেতৃত্বহীনতা, আদর্শহীনতা ও স্থানীয় রাজনীতিতে অস্ত্রের ব্যবহার—এই তিন মিলেই আজকের বিএনপির বাস্তবতা।
শুধু কালীগঞ্জ নয়, দেশের বহু এলাকায় দলীয় অভ্যন্তরীণ বিভাজনের আগুন ঘুমিয়ে আছে—যা যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে।
এখানে রাজনীতি বাঁচাতে হলে প্রথমে রক্তপাত বন্ধ করতে হবে। দলীয় নেতৃত্বকে শুধু বিবৃতি দিয়ে নয়, মাঠে থেকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে—তা না হলে প্রতিপক্ষ নয়, বিএনপি নিজেরাই নিজেদের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হবে।

 
                         
         
         
        