বরিশালের বাকেরগঞ্জে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের অস্থায়ী বুথ থেকে গ্রাহকের ১৩ লাখ টাকার বেশি আত্মসাতের ঘটনা তদন্তাধীন। জনমনে ক্ষোভ।
বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায় বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের নাম করে এক ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের একটি অস্থায়ী বুথ ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির স্থানীয় অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রায় ১৩ লাখ ৪২ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে, যার প্রভাব পড়েছে শত শত নিরীহ গ্রাহকের উপর।
এই অনিয়মের কেন্দ্রে রয়েছেন ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার সাজ্জাদ হোসেন, যিনি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামে বদলি হওয়ার আগে পর্যন্ত বাকেরগঞ্জ জোনাল অফিসের নিচতলায় অবস্থিত বুথটির দায়িত্বে ছিলেন। স্থানীয় মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট লোকমান সিকদার গ্রাহকদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ বিল সংগ্রহ করে এ বুথে জমা দিতেন এবং বিনিময়ে রসিদ দিতেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৪০ লাখ টাকার মধ্যে ১৩ লাখ টাকারও বেশি টাকা ব্যাংকের মূল হিসাবে জমা হয়নি।
দুর্নীতির ধরনটি ছিল প্রতারণার সূক্ষ্ম কৌশল: গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অস্থায়ী বুথে জমা দেওয়া হলেও সেই টাকা ব্যাংকের মেইন সার্ভারে অ্যাকাউন্টেড হয়নি। বুথের রসিদে স্বাক্ষর থাকায় গ্রাহক নিশ্চিত ছিলেন তাদের বিল জমা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তা ছিল এক ধরণের "ভুয়া নিরাপত্তা"।
অবশ্যই প্রশ্ন উঠছে—একজন জুনিয়র কর্মকর্তার একক ক্ষমতায় এত বড় পরিমাণ অর্থ গায়েব করা কি সম্ভব? এখানে যে উচ্চতর কর্তৃপক্ষেরও নৈতিক দায়িত্ব ছিল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ও বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্বে গাফিলতির কারণে প্রতারণাটি এতদূর গড়িয়েছে।
লোকমান সিকদারের মতো মধ্যবিত্ত এক ব্যক্তি গ্রাহকের চাপ সামলাতে গিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ টাকা নিজের পকেট থেকে পরিশোধ করেছেন। ১২০ জনের বেশি গ্রাহকের বিল এখনও বকেয়া রয়েছে, যেকোনো মুহূর্তে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে তারা। এমন একটি পরিস্থিতিতে লোকমানের জীবনব্যবস্থা ও সামাজিক সম্মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাজ্জাদ হোসেন আত্মসাৎ এর বিষয়ে অস্বীকার করে বলছেন, “আমরা একাধিক কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছি। তদন্তে বের হবে কে দায়ী।” ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মেজবা উদ্দীনের বক্তব্য, “অর্থ সংকটে বুথ বন্ধ করা হয়েছে।” এই ধরণের অস্পষ্ট উত্তর আসলে দায় এড়ানোর চেষ্টা বলেই প্রতীয়মান হয়।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের বর্তমান ডিজিএম এটিকে সাধারণ ‘সংযোগ বিচ্ছিন্নতার নিয়ম’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন, যা ভুক্তভোগীদের দৃষ্টিতে পুরোপুরি বানোয়াট ও দৃষ্টিকটু।
মামলাটি বর্তমানে বরিশালের জ্যেষ্ঠ বিচারিক আদালতে চলমান এবং তদন্তের দায়িত্বে আছে পিবিআই। এসআই আব্দুর রহিম ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রায় ২০ জন গ্রাহকের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। তবে তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া দীর্ঘ হলে ক্ষতির পূরণ এবং জবাবদিহিতা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
জনমনে এখন ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। একদিকে গ্রাহকরা অর্থ হারিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ হারানোর ঝুঁকিতে, অন্যদিকে দায়ী কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে দায়িত্বে।
জনগণ প্রশ্ন করছে—এমন হলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? ব্যাংক ও রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যদি এমন দুর্নীতি হয়, তাহলে কার উপর ভরসা রাখা যাবে?
এটি শুধুমাত্র একটি বিল আত্মসাতের ঘটনা নয়, এটি একটি গভীর প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিফলন, যেখানে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতিকে আড়াল করছে এবং জনগণ তার মূল্য দিচ্ছে।
এই মামলার দ্রুত তদন্ত, জবাবদিহিমূলক বিচার এবং ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা ছাড়া এই ক্ষত সেরে ওঠা সম্ভব নয়। একইসাথে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে ব্যাংক ও বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও ডিজিটাল নজরদারি জরুরি।
