 
                  পাবনার সুজানগরে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে সদস্য সচিব গুলিবিদ্ধসহ আহত অন্তত ১৫ জন। ব্যক্তিগত বিরোধ না দলীয় আধিপত্য বিস্তার—এই সহিংসতার পেছনের কারণ নিয়ে বিশ্লেষণ।
পাবনার সুজানগরে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ নতুন করে দলটির অভ্যন্তরীণ সংকট ও নেতৃত্বহীনতা প্রশ্নে তুলে এনেছে গুরুতর উদ্বেগ। এ ঘটনায় উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব শেখ আব্দুর রউফ গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন, যা ‘ব্যক্তিগত বিরোধ’ হিসেবে দায়সারা ব্যাখ্যায় ঢাকা যাচ্ছে না। বরং এটি স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক কাঠামোর শূন্যতার নগ্ন প্রকাশ বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বুধবার (৯ জুলাই) দুপুরে সুজানগর পৌরবাজারের নন্দিতা সিনেমা হল এলাকায় রক্তাক্ত সংঘর্ষটি ঘটে।
জানা যায়, একটি মেয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলা নিয়ে শুরু হয় বিরোধ, যা মঙ্গলবার মীমাংসা হলেও বুধবার তা ভয়াবহ সংঘর্ষে রূপ নেয়।
ছাত্রদল নেতা কাউছার ও তার অনুসারীরা সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মজিবর খাঁ-ঘনিষ্ঠ আশিকের মোবাইল কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে।
এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার দুপুরে কাউছার আবার আশিককে ডেকে নেয় সিনেমা হলের সামনে। সেখানে মুখোমুখি হলে হাতাহাতি থেকে শুরু হয় ছুরিকাঘাত এবং পরে সংঘর্ষে রূপ নেয়।
আশিক ও তার সহযোগী সবুজ নিজ গ্রুপের নেতা-কর্মীদের ডেকে এনে পাল্টা হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে আব্দুর রউফ ঘটনাস্থলে গিয়ে উভয়পক্ষকে থামানোর চেষ্টা করেন।
কিন্তু তিনিও আক্রান্ত হন, এমনকি গুলিবিদ্ধ হন বলে জানা গেছে। কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি।
ঘটনায় আহত হয়েছেন শেখ আব্দুর রউফসহ ১৫ জন, যাদের মধ্যে ৭ জন পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ও বাকি ৭ জন সুজানগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।
আহতদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাকর্মী এবং সাধারণ সমর্থকেরাও, যাদের বেশির ভাগই দুই গ্রুপের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
এই সংঘর্ষকে ‘ব্যক্তিগত বিরোধ’ বলেই দাবি করেছেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক তৌফিক হাসান আলহাজ্ব। তিনি বলেন, “এটি দলীয় কোনো বিষয় নয়।
আঞ্চলিক বা পারিবারিক মনোমালিন্যের বহিঃপ্রকাশ।” কিন্তু সংঘর্ষে উপজেলা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও ছাত্রদল-যুবদলের এত কর্মী জড়িত থাকার পরও একে নিছক ব্যক্তিগত বলে চালিয়ে দেওয়া কতটা যৌক্তিক, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
অন্যদিকে পুলিশ বলছে, “দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা বিএনপির মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এটি হয়তো তারই বহিঃপ্রকাশ।”
অর্থাৎ রাজনৈতিক ছায়াযুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ও নিয়ন্ত্রণ হারানোর দৃষ্টান্ত হিসেবেই এটি দেখা উচিত—এই মত পোষণ করছেন স্থানীয় বিশ্লেষকরা।
পাবনা জেলা ও বিশেষ করে সুজানগর এলাকায় বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল। স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্বে দলীয় মতভেদ, পক্ষপাত ও বিতর্ক নতুন কিছু নয়।
কিন্তু মোবাইল ফোনের মতো একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর্যায়ে চলে যাওয়া এটাই বোঝায় যে, নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্যের অভাব যেমন প্রকট, তেমনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণও কার্যত নেই।
এছাড়া এই ঘটনার সঙ্গে যদি সত্যিই নারীর সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি জড়িত থেকেও থাকে, তবে তা স্থানীয় রাজনীতির নৈতিক পতনের দিকটিও উন্মোচন করে।
ঘটনার পর পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ওসি মজিবর রহমান জানান, “এখনো কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
” তবে স্থানীয়রা বলছেন, সংঘর্ষের সময় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে দেয়, সাধারণ মানুষ নিরাপদে আশ্রয় নেয়।
স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করেছে, যাতে করে পরিস্থিতি আর না বাড়ে।
এই ঘটনা কেবলমাত্র সুজানগরের একক ঘটনা নয়, বরং দেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের ভিতরকার সংঘাত, বিশৃঙ্খলা ও নেতৃত্বের দুর্বলতার প্রতিফলন।
যেখানে একটি রাজনৈতিক দল সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেখানে তাদের নিজ দলে এমন বিশৃঙ্খলা সাধারণ মানুষ ও কর্মীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করবে তাতে সন্দেহ নেই।
আর যদি এটিই বিএনপির ‘ভবিষ্যতের নেতৃত্ব প্রস্তুতি’র নমুনা হয়, তবে তাদের আন্দোলন নয়, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই হয়ে উঠবে চ্যালেঞ্জ।

 
                         
         
         
         
         
        