বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় এক রাতে শ্বশুর ও পুত্রবধূর রহস্যজনক মৃত্যু, উভয়ের হাত বাঁধা ও গলায় ফাঁস দেওয়া লাশ উদ্ধার। জমি বিরোধ না কি পরিকল্পিত ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড? তদন্তে উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
এক অজানা আতঙ্কে ঘুম ভাঙে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার লক্ষ্মীমণ্ডপ গ্রামবাসীর। বুধবার সকালে এক বৃদ্ধ ও এক তরুণ নারীর মরদেহ উদ্ধার হয় হাত বাঁধা ও গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায়। নিহতরা হলেন অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসা শিক্ষক আফতাব হোসেন (৭০) ও তার পুত্রবধূ মোছা. রিভা (২৮)। এই নির্মম ঘটনা গোটা এলাকায় চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে, আর প্রশ্ন তুলেছে—এটি কি শুধুই ডাকাতির ঘটনা, নাকি জমি নিয়ে পুরনো কোনো শত্রুতার নিষ্ঠুর প্রতিশোধ?
আফতাব হোসেন ছিলেন স্থানীয়ভাবে সম্মানিত একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
তার ছেলে শাহজাহান সৌদি প্রবাসী, এবং পুত্রবধূ রিভা পাঁচ বছর বয়সী কন্যা মালিহা ও এক ছেলে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতেই বসবাস করতেন। ছোট ছেলে ঢাকায় কর্মরত।
পরিবারটি ছিল সমাজে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য ও নিরিবিলি জীবনযাপনকারী হিসেবে পরিচিত।
মঙ্গলবার রাত। রিভা তার ছোট মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন নিজ ঘরে, এবং আফতাব হোসেন ছিলেন নিজের কক্ষে।
পরদিন সকালে শিশু মালিহা জেগে উঠে দেখে তার মা হাত বাঁধা ও গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় নিথর পড়ে আছেন।
সাহায্যের জন্য সে ছুটে যায় পাশের বাড়িতে। প্রতিবেশীরা এসে দেখতে পান, বাড়ির বাইরে আফতাব হোসেনের লাশও একইভাবে পড়ে আছে।
ঘরে দেখা গেছে লণ্ডভণ্ড অবস্থা। আলমারি, আসবাব তছনছ—ঘরের চেহারা এক ভয়াবহ সংঘর্ষের ইঙ্গিত দেয়। স্বজনদের ভাষ্যমতে, লুটপাট হয়েছে বেশ কিছু মালামাল ও নগদ অর্থ। তবে তদন্তকারীরা বলছেন, শুধুমাত্র লুট নয়—হত্যাকাণ্ডে পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট।
স্থানীয় সূত্র জানায়, আফতাব হোসেনের সঙ্গে সম্প্রতি জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল একাধিক পক্ষের সঙ্গে। পরিবারও এই দিকটি উড়িয়ে দিচ্ছে না।
অপরদিকে, কেউ কেউ মনে করছেন এটি পেশাদার চক্রের হামলা, যারা ডাকাতির ছলে দুইজনকে হত্যা করে এলাকা ত্যাগ করেছে।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) হোসাইন মোহাম্মদ রায়হান জানিয়েছেন, “এটি নিছক ডাকাতি বা ব্যক্তিগত শত্রুতার ঘটনা নয়, আমরা তিনটি সম্ভাব্য দিক—পারিবারিক বিরোধ, জমি সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব এবং পরিকল্পিত লুটপাট—একসাথে বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছি।”
মরদেহ দুটি শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে ময়নাতদন্তের জন্য। পুলিশ ইতোমধ্যেই সম্ভাব্য সন্দেহভাজনদের তালিকা তৈরি করেছে।
এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পরিবারের ওপর নেমে আসা শোক নয়, বরং গ্রামীণ বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাকেও স্পষ্ট করে তুলেছে। জমিজমা নিয়ে বিরোধ, একক ঘরে প্রবাসীর স্ত্রী ও অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধের নিরাপত্তাহীনতা এবং অপরাধীদের ব্যবহৃত নিষ্ঠুর কৌশল—সব মিলিয়ে এটি কেবল একটি অপরাধ নয়, বরং সমাজে গভীর শঙ্কার প্রতিচ্ছবি।
এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
কারণ এই ঘটনার বিচারহীনতা কেবল এক পরিবারের নয়, বরং পুরো সমাজের মধ্যে অনিরাপত্তা ও অনাস্থার বীজ বপন করবে।
তদন্তে গতি ও নিরপেক্ষতা থাকা চাই, এবং যারা দায়ী, তাদের মুখোশ উন্মোচন এখন সময়ের দাবি।
