আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ১৯৭১-এর গণহত্যা ও ২০২৪ সালের হত্যাকাণ্ড তুলনা করে যে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড়। অভিনেত্রী শাওনের ব্যঙ্গাত্মক প্রতিক্রিয়া নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বাংলাদেশের গণস্মৃতিতে সবচেয়ে পবিত্র ও সংবেদনশীল অধ্যায় নিঃসন্দেহে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও তৎকালীন গণহত্যা। এই প্রসঙ্গেই সদ্য একটি মন্তব্য করে বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল। গতকাল রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ‘জুলাই গণহত্যার বিচার’ শীর্ষক এক আলোচনায় তিনি বলেন, “শেখ হাসিনার সরকার যে ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও এতটা জঘন্য ছিল না।”
এ বক্তব্যে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন মুক্তিযুদ্ধপ্রেমী সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা।
তাদের মতে,
৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশের ইতিহাসে এমন তুলনা শুধুমাত্র অশালীন নয়, বরং এটি একটি ঐতিহাসিক অপরাধ।
আসিফ নজরুল বলেন,
“১৯৭১ সালে মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলেছে, এমন কোনো ফুটেজ তিনি দেখেননি।”
তার মতে,
“১৯৭১ সালে কেউ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে ধরেই আবার গুলি করা হয়েছে— এমন বর্ণনাও তিনি পড়েননি।”
তিনি বলতে চেয়েছেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যেসব ছবি ও ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ্যে এসেছে— সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ আরও নির্মম ও প্রকাশ্য বর্বরতার উদাহরণ।
তবে ইতিহাসবিদ, মানবাধিকার কর্মী ও বহু সাধারণ নাগরিক একমত যে, এই তুলনা একটি বিভ্রান্তিকর, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ইতিহাস বিকৃতির প্রয়াস।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে যেভাবে ঢাকাসহ সারাদেশে গণহত্যা চালায়, নারীদের ধর্ষণ করে এবং একটি প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নেয়— তার ভয়াবহতা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত।
এই বিতর্কিত মন্তব্যের পরপরই অভিনেত্রী ও নির্মাতা মেহের আফরোজ শাওন তার ফেসবুক পেজে লেখেন:
“১৯৭১ সকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আসলে কিছুই করে নাই। আপনার দাদা শ্বশুর মাথায় ঠাডা পইড়া মারা গেছেন।”
এই পোস্টটি একটি ব্যঙ্গাত্মক প্রতিবাদ হলেও, এতে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে জনগণের অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ এবং ঐতিহাসিক বেদনার প্রতি শাওনের সংবেদনশীলতা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায় এবং মুহূর্তেই হাজার হাজার মন্তব্য ও শেয়ার জমা হতে থাকে।
বস্তুত, আসিফ নজরুলের বক্তব্য কেবল একটি বিতর্কিত মন্তব্য নয়— এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ইতিহাস ও জনমনের সংবেদনশীল স্মৃতির ওপর একটি আঘাত।
অনেক বিশ্লেষকের মতে,
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার বিচারের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে, একাত্তরের বিভীষিকাকে খাটো করা একধরনের আত্মঘাতী কৌশল।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই ২০২৪ সালের সহিংসতা নিয়ে তদন্ত দাবি করেছে, কিন্তু তারা ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে “Genocide” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বহু আগেই।
সেখানে এই দুই ঘটনাকে তুলনামূলক বিশ্লেষণে আনা যেন একটি প্রজন্মের আত্মত্যাগকে অপমানের শামিল।
আসিফ নজরুল তার বক্তব্যে বলেছেন,
“এমনভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ রেখে যাওয়া হবে, যাতে ভবিষ্যতের সরকারও বিচার থেকে সরতে না পারে।”
এটি নিশ্চয়ই একটি আশাব্যঞ্জক বার্তা।
কিন্তু সেই বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ১৯৭১ সালের মতো ঐতিহাসিক বেদনাকে খাটো করা একেবারেই অনভিপ্রেত।
বাংলাদেশের জনগণ চায়— ২০২৪ সালের অপরাধের বিচার হোক, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
তবে তারা এটা কোনোভাবেই মেনে নেবে না যে, সেই দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ১৯৭১ সালের রক্তস্নাত ইতিহাসকে কলঙ্কিত করা হোক।
