ঢাবির একসময়ের দরিদ্র ছাত্রসমন্বয়কদের পিতা মহোদয় আজ কোটিপতি! করোনাকালে যাদের ঘরে ত্রাণ পাঠানো হয়েছিল, তারা এখন বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।
২০২০ সালে, যখন গোটা দেশ থমকে গিয়েছিল করোনার ধাক্কায়, তখন রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে নেমে এসেছিল চরম দারিদ্র্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের পরিবারও এর বাইরে ছিল না। এমনকি অনেকের ঘরে ছিল না খাবার, চুলোয় জ্বলতো না আগুন। তখন ঢাবি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে অসহায়দের জন্য পাঠানো হয়েছিল ত্রাণ—চাল, ডাল, তেল, আলু। সেই তালিকায় ছিলেন ঢাবির ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমান সমন্বয়ক হান্নান মাউসদের পরিবারও।
তার পিতা আবদুল মালেক ছিলেন একজন সামান্য পিয়ন।
থাকতেন ভাঙা চালার ঘরে।
কিন্তু আজ, মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে তাদের জীবন যেন রূপকথার রাজ্যে পৌঁছে গেছে।
ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাড়ি, ব্যাংকে কোটি টাকার লেনদেন, জায়গা-জমি, গাড়ি—সবই এখন বাস্তব।
এটা কি শুধুই ভাগ্য বদলের গল্প?
নাকি এর পেছনে আছে ছাত্র রাজনীতির ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা দুর্নীতির এক অন্ধকার সাম্রাজ্য?
বিভিন্ন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাবি ছাত্রলীগের প্রায় প্রতিটি সাবেক ও বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ নেতার পরিবারের আর্থিক অবস্থা করোনাকালের আগ পর্যন্ত ছিল সীমিত।
কেউ ছিলেন রিকশাচালক, কেউ কৃষক, কেউ দিনমজুর বা অফিস সহায়ক। তাদের ছেলেরা যখন ছাত্র রাজনীতিতে পদ পেয়েছে, তখনও তারা ভরসা করতেন নেতা-কর্মীদের দেওয়া অনুদান বা উপহার খাবারে।
কিন্তু আজ তারা শহরের অভিজাত শ্রেণির বাসিন্দা।
তাদের নামে কিংবা পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারি লাইসেন্স, সরকারি প্রকল্পের অংশীদারিত্ব এবং কিছু ক্ষেত্রে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগও উঠেছে।
২০২০ সালে ঢাবি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে যাদের ঘরে ত্রাণ পৌঁছানো হয়েছিল, সেই তালিকা এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অনেকেই বলছেন,
সেই সাহায্য পাওয়া পরিবারগুলোর ছেলেরা এখন ‘সমন্বয়ক’ বা ‘উপদেষ্টা’।
রাজনীতির অন্দরমহলে তাদের প্রভাব, থানা প্রশাসন থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের গেট পর্যন্ত বিস্তৃত।
নতুন বাড়ির ছবি, বিলাসবহুল গাড়ি, দামী রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ার ছবি তারা নিজেরাই সোশ্যাল মিডিয়ায় দিচ্ছেন।
অথচ তাদের পরিবারের পেশাগত, শিক্ষাগত কিংবা ব্যবসায়িক কোনো প্রেক্ষাপট নেই যা দিয়ে এত টাকার উৎস ব্যাখ্যা করা যায়।
এই সমন্বয়কদের অর্থসম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বহুদিন ধরে।
কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুদক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন দেখেও দেখছে না।
তারা শুধু প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিচয়ের সামনে নীরব।
এই পরিবারগুলোর আয়কর ফাইল খতিয়ে দেখা গেলে হয়তো বের হয়ে আসবে, কীভাবে ১০ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারীর ছেলে কোটি টাকার ফ্ল্যাটের মালিক হয়, কীভাবে ভাঙা চালার ঘর ছেড়ে আসে গুলশানের পেন্টহাউজে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি হওয়া উচিত ছিল আদর্শ, ত্যাগ ও নেতৃত্ব তৈরির প্রশিক্ষণভিত্তিক।
কিন্তু বাস্তবতা হলো,
এখন এটি একপ্রকার ‘ইনভেস্টমেন্ট’ বা ‘পুঁজি বিনিয়োগের প্ল্যাটফর্ম’ যেখানে রাজনৈতিক পদ মানে শুধু ক্ষমতা নয়, অর্থ ও প্রভাবের অপ্রতিরোধ্য উত্থান।
বহু সমন্বয়ক কিংবা সাবেক ছাত্রনেতা এখন প্রশাসনের ভেতরে ঢুকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ধনী হয়েছেন।
অনেকেই সরকারি প্রকল্পের সাব-কন্ট্রাক্ট, ঠিকাদারি, এমনকি স্থানীয় চাঁদাবাজি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ।
এই অর্থবিত্তের উৎস কী? ছাত্রনেতাদের পিতারা হঠাৎ কোটিপতি হয়ে উঠলেন কীভাবে? দুদক কি এগিয়ে আসবে তদন্তে? নাকি সবকিছু ঢাকা পড়ে যাবে পরিচিত রাজনৈতিক ছাতার নিচে?
যখন দেশের প্রকৃত মেধাবীরা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, তখন ছাত্র রাজনীতি দিয়ে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাওয়া তরুণরা সমাজে কী বার্তা দিচ্ছে?
এই প্রশ্নগুলো এখন সময়ের দাবী।
