 
                  গাজীপুরে এক বছরে বন্ধ হয়েছে ৭২টি পোশাক কারখানা। এতে চাকরি হারিয়েছেন ৭৩ হাজারের বেশি শ্রমিক। অর্ডার সংকট, ব্যাংকের অসহযোগিতা ও আর্থিক দুরবস্থায় বিপন্ন গার্মেন্টস খাত।
গাজীপুর – দেশের পোশাক শিল্পের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র – আজ আর গর্বের স্থানে নেই, বরং হয়ে উঠেছে শ্রমজীবী মানুষের চোখের জলের উপত্যকা। গত এক বছরে ৭২টি গার্মেন্টস কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে কাজ হারিয়েছেন ৭৩ হাজার ১০৩ জন শ্রমিক-কর্মচারী। এই বিপর্যয়ের প্রতিটি স্তরে রয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতির ব্যর্থতা, ব্যাংকিং খাতের অসহযোগিতা, এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপকে সামাল দেওয়ার অক্ষমতা।
টঙ্গীর খাঁপাড়ায় অবস্থিত সিজন ড্রেসেস একসময় ছিল একটি রপ্তানিমুখী সাফল্যগাথা।
২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি একাই রপ্তানি করেছিল ৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের পোশাক।
১,২৬০ জন কর্মী-কর্মচারীর কর্মস্থলটি ছিল স্বপ্নের প্রতীক।
কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কা, কার্যাদেশ সংকট এবং সবশেষে ব্যাংকগুলোর অমানবিক ঋণনীতি এই প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেয়।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাহাউদ্দিন চৌধুরী বাকেরের বক্তব্যে ফুটে ওঠে ক্ষোভ ও বেদনা –
“ব্যাংক আগের নিয়মে টাকা নিলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিত না, কারখানাও বন্ধ হতো না।”
বাস্তবতা হলো, ব্যাংকগুলো ৮ শতাংশের জায়গায় দ্বিগুণ কিস্তি কেটে নেয়, কোনো আবেদনেও সাড়া দেয় না।
এই ‘নীরব যুদ্ধ’ই শেষ করে দেয় ২৮ বছরের বিনির্মাণ।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেক্সিমকো গ্রুপ এক সঙ্গে ১৩টি পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেয়।
শুধু এ ক্ষেত্রেই বেকার হয়ে পড়েন ২৮ হাজার ৫১৩ জন।
চক্রবর্তী, গাছা, টঙ্গী – সব শ্রমিকপল্লী আজ কেবল এক একটি শোকগাথা।
স্থানীয় বাজার, ভাড়াবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল – সবকিছুই স্থবির।
বহু শ্রমিক গ্রামে ফিরে গেছেন, অনেকে বাধ্য হয়ে ঝিয়ের কাজ বা ভাড়ায় ইজিবাইক চালানোয় নেমেছেন।
এখানে মূল প্রশ্ন উঠছে – এই সংকটে দায় কার?
ব্যাংকগুলোর রিফাইন্যান্সিং নীতির অমানবিক প্রয়োগ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কার্যকর হস্তক্ষেপের অভাব, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা, আর বিজিএমইএ’র নীরবতা – সব মিলিয়ে একটি ‘সিস্টেমিক ফেইলিওর’ এর চিত্রই ফুটে উঠছে।
এই সংকট সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে নারী শ্রমিকদের উপর।
যাদের অধিকাংশই ছিলেন একক উপার্জনকারী।
আজ তারা বাধ্য হয়ে ঘরে বসে আছেন অথবা ঘরকন্যার কাজ খুঁজছেন।
পীরগাছার শেফালী বেগমের ভাষায় –
“ঘরভাড়াসহ সংসার খরচ কোথা থেকে জোগাড় করব?”
এই প্রশ্নটি শুধু তার একার নয়, গাজীপুরের হাজারো পরিবারের।
গাজীপুরে ৭২টি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি দেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির ওপর একটি বড় আঘাত।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকার, এবং উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত চেষ্টায়ই কেবল এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।
নয়তো গাজীপুরের পর ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করবে আশেপাশের সব শিল্পাঞ্চলকেই।

 
                         
         
         
        