বাংলাদেশে সাংবাদিক নিপীড়ন নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। মোজাম্মেল বাবুর গ্রেপ্তার ঘটনাকে কেন্দ্র করে উন্মোচিত হচ্ছে সেনা-সমর্থিত সরকার ও অন্তর্বর্তী প্রশাসনের ভয়ঙ্কর নিয়ন্ত্রণনীতি।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম আজ এক নজিরবিহীন অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে। সম্পাদক, প্রতিবেদক, ফটোসাংবাদিক—কেউই এখন নিরাপদ নন। বনানী থানার একটি পুরোনো চাঁদাবাজি মামলায় ১০ই আগস্ট সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবুকে গ্রেপ্তার দেখানো এবং কারাগারে পাঠানোর ঘটনা এই বাস্তবতার আরেকটি নির্মম উদাহরণ। এটি শুধু একজন সাংবাদিকের ব্যক্তিগত বিপর্যয় নয়, বরং রাষ্ট্রের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রতিচ্ছবি।
মোজাম্মেল বাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগটি এসেছে ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের।
অভিযোগ—বৈশাখী টিভির অফিসে ১০ কোটি টাকা চাঁদা দাবি ও সাড়ে চার লাখ টাকা আত্মসাৎ।
কিন্তু পরিবারের দাবি, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা, যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পুনরুজ্জীবিত করেছে সাংবাদিক সমাজকে ভয় দেখানোর জন্য।
১১টা ৪০ মিনিটে বাবুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরিয়ে আদালতে আনার দৃশ্য—এটি কেবল নিরাপত্তাজনিত নয়, বরং ‘শক্তি প্রদর্শন’ এবং গণমাধ্যমকে বার্তা দেওয়ার এক প্রকার রাজনৈতিক থিয়েটার।
দেশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার তথ্য ভয়াবহ:
- গত এক বছরে ১০ জন সাংবাদিক নিহত
- ৪১২ জন মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলার আসামি
- ৩৯ জন গ্রেপ্তার
- ১৬৮ জনের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল
- ৩০০ জনের বিদেশযাত্রা নিষিদ্ধ
- শতাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ
- সহস্রাধিক সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের অফিস ১১ মাস ধরে তালাবদ্ধ—যা সরাসরি পেশাগত সংগঠন ধ্বংসের কৌশল।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেক বিশ্লেষক সেনা-সমর্থিত প্রশাসনের পুনরাবৃত্তি হিসেবে দেখছেন।
তারা মনে করেন, ২০০৭-২০০৮ সালের মতো এখনো রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ গণতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে।
মিডিয়া অফিসে হামলা, অফিস দখল, প্রকাশ্যে গরু জবাই করে হুমকি এবং সাংবাদিকদের তালিকা করে চাকরিচ্যুত করা—এসব পদ্ধতি একমাত্র উদ্দেশ্য নিয়েই করা হচ্ছে: ভয় সৃষ্টি এবং সংবাদ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীনতার সূচক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্রুত নিচে নামছে।
ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ‘গুরুতর সংকট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং মানবাধিকার আলোচনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ঐক্যবদ্ধ পেশাগত আন্দোলন: রাজনৈতিক বিভাজন অতিক্রম করে সাংবাদিকদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা জরুরি।
আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি: জাতিসংঘ, ইইউ, এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠনগুলোর কাছে বিস্তারিত প্রমাণ উপস্থাপন করা দরকার।
ডিজিটাল বিকল্প প্ল্যাটফর্ম: রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপ এড়াতে স্বাধীন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের বিকাশ।
মোজাম্মেল বাবুর ঘটনা কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়—এটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীনতার ক্রমবর্ধমান পতনের প্রতীক।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যেকোনো স্বৈরাচার প্রথমে আঘাত হানে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর।
আজ যারা চুপ আছেন, কাল তাদের কণ্ঠও রুদ্ধ হতে পারে।
তাই, এখনই প্রয়োজন সাহসী ও সংগঠিত প্রতিরোধ।
