রাজশাহীর ‘ডক্টরস ইংলিশ’ কোচিং সেন্টারে সেনাবাহিনীর অভিযানে বিপুল অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে। রাজনৈতিক যোগসূত্র, জঙ্গি ছদ্মবেশ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক—ঘটনার বিশ্লেষণ।
শিক্ষা মানুষের মুক্তির পথ। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে যদি অন্ধকার নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে, তাহলে সমাজের জন্য সেটি হয়ে দাঁড়ায় ভয়াবহ হুমকি। রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় ‘ডক্টরস ইংলিশ’ নামের একটি কোচিং সেন্টারে সেনাবাহিনীর অভিযানে বিপুল অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধারের ঘটনা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নতুন করে নাড়া দিল।
শনিবার ভোরে সেনাবাহিনীর ৪০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাড়িটি ঘিরে ফেলে।
পরে ভেতরে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়—বিদেশি এয়ার গান, রিভলবার, কর্টিজ, দেশীয় অস্ত্র, জিপিএস, ওয়াকিটকি, ট্রাজারগান, বাইনোকুলার, বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম, বিভিন্ন নথিপত্র, কম্পিউটার, স্ক্যানার এমনকি ৩৫ বোতল বিদেশি মদ।
উদ্ধারকৃত সরঞ্জামের তালিকা ইঙ্গিত করে যে, এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার জন্য রাখা হয়নি; বরং কোনো সংগঠিত পরিকল্পনা ও নাশকতা কার্যক্রমের প্রস্তুতি ছিল এর পেছনে।
কোচিং সেন্টারের পরিচালক মুনতাসিরুল আলম অনিন্দ্য শুধু শিক্ষাবিদ বা ব্যবসায়ী নন।
তিনি বিএনপি রাজনীতির প্রভাবশালী ব্যক্তি শফিউল আলম লাট্টুর ছেলে এবং রাজশাহীর সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।
অনিন্দ্য অতীতে হলি আর্টিজান হামলার পর জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ এফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডেও তার নাম উঠে আসে।
এতকিছুর পরও তিনি আবারও অস্ত্র–বিস্ফোরকের জাল বুনতে পেরেছেন—এটাই বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশে গত এক দশকে দেখা গেছে, মাদরাসা, মসজিদ, এমনকি স্কুল-কলেজের আড়ালে বহুবার চরমপন্থী কার্যক্রমের গোপন আস্তানা গড়ে উঠেছে।
এবার একটি ইংরেজি কোচিং সেন্টারকে ব্যবহার করা হলো অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক মজুদের জন্য।
এটি প্রমাণ করে, জঙ্গি নেটওয়ার্ক তাদের কৌশল পাল্টাচ্ছে। তারা জানে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর সাধারণত ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে থাকে।
তাই এবার তারা শহরের অভিজাত এলাকায় আধুনিক কোচিং সেন্টারকে বেছে নিয়েছে—যেখানে অভিভাবকরা নির্দ্বিধায় সন্তানদের পাঠান।
অভিযুক্ত অনিন্দ্যের অতীত ইতিহাস ও রাজনৈতিক পরিচয় স্পষ্ট করে যে, তিনি কেবল একক ব্যক্তি নন, বরং একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক বলয়ের ছায়া তার ওপর রয়েছে।
প্রশ্ন হলো—
কে বা কারা তাকে দীর্ঘদিন সুরক্ষা দিয়েছে?
আরেকটি প্রশ্ন হলো—সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে শিক্ষা ও ব্যবসার আড়ালে অস্ত্র-কারবার কতটা বিস্তৃত হয়েছে?
এই ঘটনা আমাদের সামনে তিনটি মৌলিক সতর্কবার্তা রেখে যায়—
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নজরদারির আওতায় আনতে হবে।
রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রভাবশালী বংশের কারণে কেউ যেন আইনের ঊর্ধ্বে না থাকে।
সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বিত অভিযান ছাড়া এই নেটওয়ার্ক ভাঙা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ এখনো ২০১৬ সালের হলি আর্টিজান ঘটনার ক্ষত বহন করছে। নতুন করে অস্ত্রের ভান্ডার আবিষ্কার আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জঙ্গিবাদ এখনও নির্মূল হয়নি, বরং নতুন ছদ্মবেশে ফিরে আসছে।
