বাংলাদেশের হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগকে ঘিরে ‘জামাই কোটা’ বিতর্ক নেটিজেনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে এই নিয়োগ বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলছে।
বাংলাদেশের হাইকোর্টে ২৫ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন (২৫ আগস্ট ২০২৫) প্রকাশের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘জামাই কোটা’ বিতর্ক তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই বিতর্কের কেন্দ্রে আছেন নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারক মো. লুৎফুর রহমান, যিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের শ্বশুর।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক নেটিজেন এই নিয়োগকে আখ্যা দিয়েছেন ‘জামাই কোটা’।
এক্স (সাবেক টুইটার)-এ একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন,
“যে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছর ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমেছিল, সেই স্বজনপ্রীতির কোটা কি আবার ফিরে আসছে?”
আরেকজনের মন্তব্য—“বিচার বিভাগ যদি জামাই কোটা দিয়ে চলে, তবে জনগণের কাছে ন্যায়বিচার কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে?”
এই মন্তব্যগুলো শুধু ক্ষোভ প্রকাশ করছে না, বরং গত বছরের রক্তক্ষয়ী কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটও মনে করিয়ে দিচ্ছে।
লুৎফুর রহমান গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান।
তখনও তার রাজনৈতিক শ্বশুর-জামাই সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল।
এবার বিচারক নিয়োগে তার নাম আসায় জনগণের মধ্যে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে—এটি কি যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়েছে, নাকি রাজনৈতিক সংযোগের ফল?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সারজিস আলমের মতো উত্তরাঞ্চলের একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার শ্বশুর হিসেবে তার অবস্থানই হয়তো নিয়োগকে সহজ করেছে।
এমন প্রভাবশালী সংযোগ বাংলাদেশের বিচার বিভাগে দীর্ঘদিনের একটি অস্বচ্ছ বাস্তবতা।
রাষ্ট্রপতির আদেশে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও এখানে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এড়ানো যাচ্ছে না।
আইন সচিব শেখ আবু তাহের নিজেও এবার অতিরিক্ত বিচারক হয়েছেন, যা আরেকটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া আসলে কতটা স্বচ্ছ?
একজন সিনিয়র আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্তব্য করেছেন:
“গণ-অভ্যুত্থানের পর জনগণ একটি নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক বিচার বিভাগ আশা করেছিল।
কিন্তু এই ধরনের স্বজনপ্রীতির নিয়োগ সেই আশাকে ম্লান করেছে।”
২০২৪ সালের জুলাইয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় বাঁক তৈরি করেছিল।
সরকারি চাকরিতে বৈষম্য ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয় এবং বহু প্রাণ ঝরে যায়।
সেই আন্দোলনের অন্যতম বার্তা ছিল—যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ, স্বজনপ্রীতির অবসান।
কিন্তু লুৎফুর রহমানকে ঘিরে এই বিতর্ক জনগণের কাছে প্রশ্ন তুলছে—ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সেই সংস্কার কি আবার স্বজনপ্রীতির কাছে পরাজিত হচ্ছে?
নেটিজেনদের ক্ষোভ শুধু ব্যক্তিকে ঘিরে নয়, বরং সমগ্র বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
যদি বিচারক নিয়োগেও রাজনৈতিক সংযোগ ও আত্মীয়তার প্রভাব কাজ করে, তবে সাধারণ জনগণ কীভাবে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা পাবে?
হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ নিয়ে ‘জামাই কোটা’ বিতর্ক বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
এই ঘটনাটি স্পষ্ট করে দিয়েছে—গণ-অভ্যুত্থানের পরও সংস্কারের পথ কঠিন ও জটিল।
জনগণের আশা ছিল—স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি বিচার বিভাগ, যেখানে যোগ্যতাই হবে একমাত্র মানদণ্ড।
কিন্তু সাম্প্রতিক নিয়োগে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা প্রমাণ করছে—সংস্কারের জন্য আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ জরুরি।
