 
                  বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা’ দাবি ঘিরে নতুন বিতর্ক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পাকিস্তানি সেনানিবাসে অবস্থান করেছিলেন—এই তথ্য ইতিহাসকে কোথায় দাঁড় করায়? বিশ্লেষণ জানুন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামই নয়, বরং এটি জাতির আত্মপরিচয় ও রাষ্ট্রীয় ভিত্তি নির্ধারণের এক অনন্য মহাকাব্য। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কে কী অবদান রেখেছেন—এই প্রশ্ন সর্বদাই আলোচনায় থেকেছে। তবে সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে “প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা” আখ্যায়িত করার মাধ্যমে একটি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ঐতিহাসিক দলিল ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া ছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে।
পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা মেজর জানজুয়ার পরিবারের আতিথেয়তায় ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করেন তিনি।
অর্থাৎ, মুক্তাঞ্চলে বা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কোনো সক্রিয় ভূমিকা পালনের ঘটনা তার জীবনীতে পাওয়া যায় না।
সম্প্রতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু দাবি করেছেন—
“বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা।
নয় মাস তিনি ক্যান্টনমেন্টে মেজর জানজুয়ার খাটে শুয়ে যুদ্ধ করেছেন, যা স্বাধীনতার সংগ্রামে বড় ভূমিকা রেখেছিল।”
এমন বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক পরিহাসই নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার এক প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে—
যে ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময় শত্রু বাহিনীর সুরক্ষায় ছিলেন, তিনি কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন?
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তার নাম নেই।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এ সামরিক অফিসারের স্ত্রীকে এতদিন বিএনপি বলত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী।
কিন্তু তারা এবার খালেদা জিয়াকে বানিয়ে দিল নারী মুক্তিযোদ্ধা।
একাত্তরে খালেদা জিয়া কোথায় মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন?
একটি টেলিভিশন চ্যানেলে ওই সময়কার ঘটনাগুলো জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দীন আহমেদ বীরউত্তম।
তার তথ্যমতে চট্টগ্রামে থাকা বেগম খালেদা জিয়া তখন ক্যাপ্টেন হারুনুর রশিদের বাসায় ছিলেন।
মেজর জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারত চলে যান।
আর বেগম খালেদা জিয়া চলে আসেন মৃত্যুপুরী ঢাকায়।
জিয়াউর রহমানের অনুরোধে বেগম খালেদা জিয়াকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা আসেন ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দীন ও তার সঙ্গীরা।
তাদের সহায়তা করার জন্য একজন ল্যান্স নায়েককেও গাইড হিসেবে পাঠিয়েছিলেন জিয়া।
খালেদা জিয়া যেখানে যেখানে থাকতে পারেন, সেসব জায়গার ঠিকানাও দিয়েছিলেন।
ওইসব ঠিকানা অনুসারে ঘোরাঘুরির পর শেষে তিনি গুলশান ১ নম্বরের একটি বাড়িতে এসে খালেদা জিয়ার খোঁজ পান।
বাড়ির দারোয়ানের কাছে জানতে পারেন, বেগম খালেদা জিয়া ওই বাড়ি থেকে আগের দিনই ঢাকা সেনানিবাসে চলে গিয়েছেন।
খবর নিয়ে জানতে পারেন, ওই বাড়িতে কোনো সেনাপ্রহরা ছিল না।
তার মানে বেগম খালেদা জিয়া বন্দি ছিলেন না।
এদিকে নিজের স্ত্রীর সন্ধান পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন জিয়া।
আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে আবারও নিজের স্ত্রীকে কাছে পেতে ক্যাপ্টেন গাফফারকে অনুরোধ করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
ক্যাপ্টেন গাফফার বলেন,
‘বেগম খালেদা জিয়াকে ভারতে নিয়ে যেতে আসা দ্বিতীয় দফায় সাত মুক্তিযোদ্ধার ৬ জনই প্রাণ হারিয়েছেন।
আবার পাঠানো কি ঠিক হবে?’
তবু জিয়ার পীড়াপীড়িতে আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপকে ঢাকায় পাঠান ক্যাপ্টেন গাফফার।
এ গ্রুপটি খালেদা জিয়ার দেখা পান হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সুইমিং পুলে।
মেজর জিয়ার নির্দেশে তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনেই ক্ষেপে ওঠেন বেগম জিয়া।
উল্টো মুক্তিযোদ্ধাদের ধমক দিয়ে বলেন, ওই মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধারা স্থান ত্যাগ না করলে তিনি আর্মি ডাকবেন এবং তাদের ধরিয়ে দেবেন।
বেগম জিয়াকে উদ্ধার করতে আসা আগের গ্রুপের ছয়জন মুক্তিযোদ্ধার শহীদ হওয়ার কথা ভেবে তারা দ্রুত হোটেল থেকে বেরিয়ে আসেন।
বিড়াল যতই থলের ভিতর লুকিয়ে রাখা হোক না কেন, সে বেরোবেই। এবার বেড়ালটাকে দেখা যাক। ১৯৯৩ সালের ৮ জানুয়ারি, পাকিস্তান সেনাবাহিনির প্রধান জেনারেল আসিফ নওয়াজ জানজুয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠালেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
বাসস-এর বরাতে ৯ জানুয়ারি দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক, সংবাদ, অবজারভারসহ প্রায় সব পত্রিকার প্রথম পাতায় এ শোকবার্তা ছাপা হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যা অভিযানে সরাসরি জড়িত ছিলেন জানজুয়া।
নির্বিচারে বাঙালি নিধন, ধর্ষণ, লুটপাটের দায়ও তার ওপর বর্তায়।
কাজেই এ জানজুয়ার শোকবার্তায় বেগম জিয়া নিজের পরিচয়টাই প্রকাশ করেছেন।
ওই সময় রাজনৈতিক আলোচনায় বলা হতো, তিনি জানজুয়াকে নাকি শেষ দেখা দেখতে যেতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় যাননি।
এখানেই শেষ নয়।
২০০৫ সালের ৩ মে মৃত্যুবরণ করেন জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।
বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করা জগজিৎ সিংয়ের মৃত্যুতে কোনো শোকবার্তাই পাঠাননি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি তার এই দুর্বলতা এবং মুক্তিযুদ্ধে সহযোগী বাহিনীর প্রতি তার এ অসন্তুষ্টি কী প্রমাণ করে?
ইতিহাস বিকৃতির এ ধরনের প্রচেষ্টা শুধু রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য হলেও তা জাতির জন্য ভয়াবহ বার্তা বহন করে।
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে।
খালেদা জিয়াকে “প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা” আখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা মূলত একটি রাজনৈতিক কৌশল, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি সেনানিবাসে ছিলেন—এটি এক অস্বীকারযোগ্য সত্য।
ইতিহাসকে বিকৃত করে কারও রাজনৈতিক বৈধতা বাড়ানো যায় না।
বরং এতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 
                         
         
         
        