জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল ১৯ জানিয়েছে, বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা গভীর সংকটে রয়েছে। নতুন আইনের খসড়াগুলো মত প্রকাশ ও গোপনীয়তাকে সীমিত করতে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখন গুরুতর সংকটের মুখে— জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ৬০তম অধিবেশনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল ১৯ এমনটাই জানিয়েছে। সংস্থাটির মতে, ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের জন্য নিরাপদ পরিবেশ এখন অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
আর্টিকেল ১৯ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের মতো কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও নতুন প্রস্তাবিত কয়েকটি আইন উদ্বেগজনকভাবে মত প্রকাশ, গোপনীয়তা ও অনলাইন স্বাধীনতাকে সীমিত করতে পারে।
সংস্থার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এসব আইনে রয়েছে—
- সুরক্ষিত বক্তব্যকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা,
- অতিরিক্ত কনটেন্ট অপসারণ,
- রাষ্ট্রীয় নজরদারি বৃদ্ধি,
- এবং আইনি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার অভাব।
এই আইনগুলো কার্যকর হলে নাগরিক ও সাংবাদিক উভয়েরই তথ্যের অধিকার ও স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ মারাত্মকভাবে সংকুচিত হতে পারে, যা গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তির পরিপন্থী।
২০২৫ সালেও সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন ও খন্দকার শাহ আলম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছে আর্টিকেল ১৯।
এ ঘটনাগুলো বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।
বিশেষ করে নারী সাংবাদিকরা আরও গভীর সংকটে আছেন।
তারা কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, অনলাইন হুমকি, এমনকি ধর্ষণের হুমকির মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়ছেন।
সংস্থাটি বলেছে, যারা একাধিক বৈষম্যের শিকার—যেমন নারী, সংখ্যালঘু, ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্য—তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের আহ্বান
আর্টিকেল ১৯ স্পষ্টভাবে আহ্বান জানিয়েছে যে,
ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই নতুন আইনের খসড়াগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।
তাদের সুপারিশ অনুযায়ী—
- সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর সব ধরনের হামলার নিরপেক্ষ, দ্রুত ও কার্যকর তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে।
- তদন্তে লিঙ্গ ও বৈচিত্র্যভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
- এবং এমন একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নাগরিকরা ভয় ছাড়াই কথা বলতে পারেন, প্রশ্ন তুলতে পারেন, এবং রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারেন।
বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সংকট কেবল সাংবাদিকদের নয়—এটি সমগ্র সমাজের গণতান্ত্রিক অস্তিত্বের প্রশ্ন।
যেকোনো সরকার যদি সমালোচনাকে রাষ্ট্রবিরোধিতা হিসেবে দেখে, তবে তা স্বাভাবিক রাজনীতিক সংস্কৃতিকে ভেঙে দেয় এবং ভয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে।
জাতিসংঘে আর্টিকেল ১৯-এর এই মন্তব্য তাই শুধুমাত্র একটি রিপোর্ট নয়;
এটি বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের আন্তর্জাতিক সতর্কবার্তা—যেখানে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি একত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
নির্বাচনের আগে সরকার যদি গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রকে উন্মুক্ত না করে, তবে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা উভয়ই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার কেবল একটি সাংবিধানিক বিষয় নয়; এটি রাষ্ট্রের আত্মার প্রতিচ্ছবি।
তাই এই সংকটে সবচেয়ে জরুরি হলো—
আইনগত সংস্কার,
সাংবাদিক নিরাপত্তা, এবং
গণতান্ত্রিক সহনশীলতা প্রতিষ্ঠা।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র নির্ভর করছে এই তিনটি উপাদানের বাস্তবায়নের ওপর।
