আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড শুধু এক মর্মান্তিক ঘটনা নয় — এটি প্রোপাগান্ডা, রাজনৈতিক একগুঁয়ে স্বার্থ ও বিচারহীনতার একটি চিহ্ন; কীভাবে অনাবিল জনমানস এবং নীতি-বিরোধী বাস্তবতা এই চক্রকে পুষ্ট করে, বিশ্লেষণ।
আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড — যদি ঘটনাক্রম, ধারাবাহিকতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আলাদা করে না দেখা হয়, তা হলে কেবল এক বা দুই জন ব্যক্তির দোষভার ধার্য করেই বিষয়টি শেষ হয়ে যাবে। (গণমাধ্যমে যা আলোচনা হয়েছে) এই হত্যা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত: একটি রাজনৈতিক ‘চিহ্ন’ নির্মাণ করে তাতে জনমত ভরিয়ে দেওয়া—ভারতবিরোধী ভাবনার প্রতীক হিসেবে নিয়োগ করে সামাজিক উত্তেজনা তৈরি। কিন্তু এখানে যে বিষয়গুলো আরও গভীরে দেখা প্রয়োজন, তা হল: (১) প্রোপাগান্ডার পরিসর ও কৌশল, (২) বিচার ও দণ্ডপ্রক্রিয়ার ব্যর্থতা থেকে উদ্ভূত অনুপ্রেরণা, (৩) অর্থনৈতিক ও নীতিগত বাস্তবতার বিভেদ — এবং (৪) জনমানসের শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব।
প্রোপাগান্ডা কেবল তথ্য দেওয়া নয়; সেটি ‘অর্থ’ দেয়, মানে বোঝার প্যাটার্ন ও প্রতিক্রিয়ার পথ তৈরি করে।
একটি জনসমষ্টিকেই যদি ধারাবাহিকভাবে একটিই রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক বার্তা খাওয়ানো হয়—তিনি তা যাচাই না করে গ্রহণ করতে প্রবণ হন।
এখানে প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া, স্থানীয় নেতাদের বক্তৃতা—
এসব মিলে একটি কৃত্রিম রিয়ালিটি তৈরি করে, যাকে প্রয়োজনে কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা যায় ‘প্রতীক’ বানাতে।
আবরারকে ‘ভারতবিরোধীর’ প্রতীক বানানোর চেষ্টা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা হলে এটি প্রমাণ করে যে তথ্য-পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত হলে শেখানো/প্রতিষ্ঠিত ন্যারেটিভে মানুষ দ্রুত মানিয়ে নেয়—
এবং ফলস্বরূপ, ন্যায্য বিচার ও ম্যান্টলি স্বাধীন বিবেচনা হারায়।
বিচারহীনতা: ক্ষমতা ও দণ্ডমুক্তির বিপজ্জনক সংকেত
মূল খুনি পরবর্তী সময়ে পালিয়ে গেছেন ও তাকে আর পাওয়া যায়নি; এবং হত্যাকারীদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন শিবিরের সাবেক নেতা।
ক্ষমতায় থাকা দল বা ক্ষুদ্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী যদি দণ্ডপ্রক্রিয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, তাতে কোনও শাস্তির ভীতি থাকে না।
বিচারহীনতা শুধু বিচারহীন ব্যক্তিকে নয়, পুরো সমাজকে অনুপ্রাণিত করে—যোগাযোগ হয় “ক্ষমতাই সবচেয়ে বড় আশ্রয়” এই ধারণায়।
এ অবস্থা আরও রাজনৈতিক হিংস্রতা, ছিন্নবিচ্ছিন্ন ন্যায়ের অনুপস্থিতি ও প্রতিশোধমূলক কাজকে উৎসাহিত করে।
চমকপ্রদ যে—যদিও কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী ভারতবিরোধী বাগান সেসব ন্যারেটিভ চাষ করেছিল,
তবে বাস্তবে বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত ও চাহিদার কারণে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য—বিশেষত ইলিশ আমদানি—বৃদ্ধি পেয়েছে।
৫০০ টন থেকে ১২০০ মেট্রিক টনে ইলিশ রফতানি-আয়াতের বড় পরিবর্তন তুলে ধরে যে নীতিগত কংগ্রুটিওয়া নেই:
জনগণের জন্য ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির জন্য কার্যকর বাস্তবনীতি বজায় থাকলে, কখনো কখনো রাজনীতির ‘বিবাদ’ আর বাস্তব জীবনের প্রয়োজনে বড় ফারাক থাকে।
এই দ্বৈতচিত্র জনগণকে বিভ্রান্ত করে: যুক্তি নয়—ইমোশন ও সিম্বলই অধিকাংশ সময় প্রবলভাবে কাজ করে।
সমাজ-মানসের বিকাশ: শিক্ষার গুরুত্ব
‘বৃহৎ অংশের জনগোষ্ঠীর মস্তিষ্ক ব্যবহার—এটি শুধু অপমান নয়, বরং ইঙ্গিত দেয় যে গণতান্ত্রিক সমাজে সমালোচনামূলক শিক্ষার অভাব লভ্যাংশে।
যুক্তি-নির্ভর বোঝাপড়া, তথ্য যাচাই, মৌলিক মানবিক নৈতিকতা—এসব না থাকলে যারা কার্যকর প্রোপাগান্ডা চালায়, তারা সহজে জনমত বানাতে পারে।
ফলে ভবিষ্যৎ নির্মাণে গণশিক্ষা ও গণমাধ্যম সাক্ষরতার ওপর বিনিয়োগ জরুরি।
আবরার ফাহাদের মৃত্যু কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়—এটি একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকেত।
লাশের রাজনীতির পেছনে যারা থাকেন, তারা জানে কীভাবে প্রতীক গঠন করে, কীভাবে জনমানসকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং কীভাবে ক্ষমতার লোভে ন্যায়ের পথে বাধা দেয়।
যদি আমরা সত্যিকারের নিষ্ঠার সঙ্গে বিচারপ্রক্রিয়া চালাই, তথ্য-সচেতনতা বাড়াই এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা জোরদার করি—
তবে এই ধরনের ‘প্রয়োজনীয়’ আরেকটি আবরারকে আমরা রুখতে পারি।
না হলে এটি সত্যি হয়ে যাবে: ‘একমাত্র লাশের রাজনীতির প্রয়োজনে আরও বহু আবরারকে’ আমরা হারাবো।
