 
                  গুম নাটকের কুশীলব মাইকেল চাকমা আত্মগোপন ভেঙে প্রকাশ্যে আসার পর আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ইউপিডিএফের হাতে অস্ত্র মজুদ, চাঁদাবাজি ও হত্যার রাজনীতিতে নতুন করে বেড়েছে উদ্বেগ।
একসময় “গুম” হওয়া ব্যক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন মাইকেল চাকমা। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসার মধ্য দিয়ে তিনি যেন আবারও প্রমাণ করলেন—পাহাড়ের অশান্তি ও রাজনীতির জটিল সমীকরণে তার প্রভাব এখনো গভীর।
মাইকেল চাকমা এখন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর প্রকাশ্য মুখ, যিনি শুধু পাহাড় নয়, সমতলেও “অপরাজনীতি”র প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
তার নেতৃত্বে আবারও উসকে উঠেছে চাঁদাবাজি, সশস্ত্র সংঘাত ও আধিপত্যের লড়াই—যা পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৮ বছরের অর্জনকে হুমকির মুখে ফেলছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পর আশা করা হয়েছিল, পাহাড়ে শান্তি ও উন্নয়নের নতুন অধ্যায় শুরু হবে।
কিন্তু ইউপিডিএফ শুরু থেকেই এই চুক্তিকে “বিশ্বাসঘাতকতা” বলে প্রত্যাখ্যান করে “পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন”-এর দাবিতে সশস্ত্র অবস্থান নেয়।
নিরাপত্তা সূত্র অনুযায়ী, বর্তমানে সংগঠনটির হাতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে—যার একটি বড় অংশ শান্তিচুক্তির আওতায় জমা দেওয়া হয়নি।
ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের প্রমাণও পাওয়া গেছে।
এর অর্থ জোগাচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের কাছ থেকে আদায় করা চাঁদা, এমনকি পর্যটকদের কাছ থেকেও।
এই অর্থেই ইউপিডিএফ পাহাড়ে শক্তিশালী অস্ত্র মজুদ গড়ে তুলছে, যা কেবল স্থানীয় নিরাপত্তার জন্য নয়, দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
মাইকেল চাকমা: পাহাড়ের “অস্থিরতার স্থপতি”
মাইকেল চাকমার রাজনৈতিক উত্থান যেমন নাটকীয়, তেমনি বিতর্কিতও।
২০০৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে একাধিক হত্যা, অস্ত্র চোরাচালান ও চাঁদাবাজির মামলায় তার নাম উঠে এসেছে।
বিশেষত ২০১৮ সালের নানিয়ারচর হত্যাকাণ্ডে শক্তিমান চাকমা ও তপন জ্যোতির মৃত্যুর ঘটনায় মাইকেলকে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়।
সেই সময় থেকেই তিনি “পাহাড়ের অস্থিরতার স্থপতি” হিসেবে চিহ্নিত হন।
২০১৯ সালে তার “গুম” হওয়ার খবর যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়, তখন মানবাধিকার সংস্থাগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর দায় চাপায়।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, মাইকেল নিজেই আত্মগোপনে ছিলেন—এবং পরবর্তীতে ওই “গুম নাটক” ব্যবহার করে সরকারবিরোধী প্রোপাগান্ডা চালান।
মাইকেল চাকমার “গুম” হওয়া ও পুনরুত্থান এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি কেস স্টাডি।
তার অন্তর্ধানকে কেন্দ্র করে যেমন আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছিল, তেমনি ফিরে এসে তিনি আবারও “ভিক্টিম কার্ড” খেলছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “গুম” নাটক আসলে একটি পরিকল্পিত অপারেশন, যার লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মহলে প্রচারণা চালানো এবং পাহাড়ে নতুন করে সশস্ত্র রাজনীতি উসকে দেওয়া।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ইউপিডিএফ এখন রাজনৈতিক সংগঠন নয়, বরং একটি “অস্ত্র ও অর্থনীতি-নির্ভর সংঘবদ্ধ চক্র।”
তাদের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে—
- স্থানীয়দের ওপর চাঁদা আদায়,
- ঠিকাদারদের হুমকি দিয়ে অর্থ দাবি,
- সীমান্তপথে অস্ত্র চোরাচালান,
- মাদক ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ।
এর সঙ্গে যুক্ত থেকে মাইকেল চাকমা আবারও পাহাড়ি রাজনীতির “কিংমেকার” হয়ে উঠেছেন।
শান্তিচুক্তির ২৮ বছর পর: কোথায় যাচ্ছে পাহাড়?
১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক।
কিন্তু তিন দশক পরও সেই চুক্তি বাস্তবায়নের বদলে পাহাড়ে অস্ত্রের ছায়া আরও ঘন হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, মাইকেল চাকমার মতো ব্যক্তিরা যতদিন আইনের আওতার বাইরে থাকবে, ততদিন শান্তিচুক্তির মূল উদ্দেশ্য—আস্থা ও সহাবস্থান—অর্জন সম্ভব নয়।
পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে, প্রথমে দরকার “অস্ত্রের রাজনীতি”র অবসান এবং “গুম-প্রোপাগান্ডা রাজনীতি”র দায়মুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা।
গুম থেকে পুনরুত্থান, অস্ত্র থেকে প্রোপাগান্ডা—মাইকেল চাকমার গল্প কেবল একজন মানুষের নয়, বরং পুরো পার্বত্য রাজনীতির এক আয়না।
এই আয়নায় প্রতিফলিত হয় আমাদের রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা, শান্তিচুক্তির অপূর্ণতা এবং নিরাপত্তা রাজনীতির অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব।
যদি এই চক্র ভাঙা না যায়, তবে পাহাড়ে শান্তি নয়—শুধু ধোঁয়াশাই বাড়বে।

 
                         
         
         
         
         
        