পঞ্চগড়ে এনসিপির কর্মসূচিতে বিদ্যুৎ বিভ্রাটকে কেন্দ্র করে সারজিস আলমের তীব্র ক্ষোভ ও হুমকি রাজনীতির নতুন এক মাত্রা উন্মোচন করেছে। এটি কি কেবল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, নাকি প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তারের ইঙ্গিত? বিশ্লেষণ করেছেন আমাদের প্রতিবেদক।
পঞ্চগড়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত লংমার্চের শেষ প্রান্তে যখন সারজিস আলম বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। মুহূর্তেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন—‘নেসকোর মালিক ও তার বাপকে জবাব দিতে হবে’, এমন কঠোর হুমকিসূচক বক্তব্য দেন তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি আরও বলেন, ‘দেউলিয়াদের কলিজা ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে রাখব।’
একজন আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতার মুখে এই ধরনের ভাষা, হুমকি ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ—এটি কেবল ব্যক্তিগত আবেগের প্রতিফলন নয়;
বরং এর পেছনে লুকিয়ে আছে স্থানীয় রাজনীতির এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক সংকট।
নেসকো (নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড) উত্তরাঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা।
স্বাভাবিকভাবে, বিদ্যুৎ বিভ্রাট একটি কারিগরি ত্রুটি বা লোড ম্যানেজমেন্টের অংশও হতে পারে।
কিন্তু রাজনীতির উত্তপ্ত মঞ্চে তা যখন ঘটে, তখন এর ব্যাখ্যা আর কারিগরি থাকে না—তা রাজনৈতিক হয়ে ওঠে।
সারজিস আলমের বক্তব্যে
‘রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক আচরণ’ এবং ‘খুনি হাসিনা’র উল্লেখ প্রমাণ করে, তিনি বিদ্যুৎ বিভ্রাটকে কেবল প্রশাসনিক ত্রুটি নয়, বরং ‘ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রিত পরিকল্পিত বাধা’ হিসেবে দেখেছেন।
গত এক বছরে উত্তরাঞ্চলে সরকারবিরোধী বক্তব্য, দুর্নীতির অভিযোগ ও স্থানীয় প্রশাসনের ওপর ক্ষোভ বেড়েছে।
সারজিস আলমের ভাষায় উঠে এসেছে সেই অস্থিরতার প্রতিধ্বনি—যেখানে তিনি “চাঁদাবাজ, সিন্ডিকেট, মাদক ব্যবসায়ী ও দখলদারদের” বিরুদ্ধে এক ধরনের ‘নৈতিক অভিযান’-এর ঘোষণা দেন।
তবে এই নৈতিক অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ বক্তব্যের ভাষা ও আক্রমণাত্মক ভঙ্গি রাজনৈতিক সহনশীলতার সীমা অতিক্রম করেছে।
বরং এটি রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অবমাননা এবং প্রশাসনিক হুমকির এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আড়ালে উত্তরাঞ্চলের ‘বিদ্যুৎ রাজনীতি’
পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যুৎ সরবরাহ ঘিরে অসন্তোষ রয়েছে।
এনসিপির মতো নতুন দলগুলো এই অসন্তোষকে রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করছে।
বিদ্যুৎ বিভ্রাট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠনের এ প্রচেষ্টা আসলে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার কৌশলও হতে পারে।
সারজিস আলমের ‘কলিজা ছিঁড়ে ফেলার’ হুমকি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বক্তব্যে নতুন নয়—তবে এটি গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য ভয়াবহ সংকেত।
যখন রাজনৈতিক নেতা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ‘ব্যক্তিগত প্রতিশোধের ভাষায়’ আক্রমণ করেন, তখন তা কেবল একজন ব্যক্তির ক্ষোভ নয়—
বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি এক অবমাননা।
এনসিপির লংমার্চে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি কেবল এক ঘণ্টার বিদ্যুৎ বিভ্রাট নয়,
এটি বাংলাদেশের আঞ্চলিক রাজনীতিতে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভাষার’ ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ও সহিংস মনোভাবের ইঙ্গিত বহন করে।
রাজনীতি যদি প্রশাসনিক কাঠামোকে প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে, তাহলে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা আরও ভাঙবে।
