 
                  ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে ইটালিতে সমুদ্রপথে আসা অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশিরাই শীর্ষে। এই অভিবাসনের পেছনে কী কারণ? অর্থনৈতিক চাপ, দুর্নীতি নাকি ব্যর্থ রাষ্ট্রনীতি।
ইউরোপের সীমান্ত ক্রমশ কঠোর হচ্ছে, ভূমধ্যসাগর হয়ে পাড়ি দেওয়ার পথ হয়ে উঠছে আরও ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও ২০২৫ সালে এই সময় পর্যন্ত ইটালিতে পৌঁছানো অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশিরাই শীর্ষে—এই পরিসংখ্যান নিছক সংখ্যাতত্ত্ব নয়, এটি এক ভয়াবহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বার্তা। ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে মোট ১৫,৪৭৬ জন বাংলাদেশি সমুদ্রপথে ইটালির উপকূলে পৌঁছেছেন—
যা মোট আগমনকারীদের প্রায় ৩০ শতাংশ।
অর্থাৎ, প্রতি তিনজন অভিবাসীর একজনই বাংলাদেশি।
পূর্বে আফ্রিকার দেশগুলো—বিশেষ করে লিবিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া ও সুদান—ছিল ইউরোপমুখী মানবস্রোতের প্রধান উৎস।
কিন্তু গত দুই বছরে চিত্র বদলেছে।
এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান, নতুন মানবস্রোতের মূল উৎসে পরিণত হয়েছে।
ইরিত্রিয়া (৭,০৯০) ও মিশর (৬,৫৫৮) থেকেও অনেক অভিবাসী এলেও সংখ্যায় তারা বাংলাদেশিদের পেছনে।
২০২৪ সালের প্রথম নয় মাসে ৮,৫২৬ জন বাংলাদেশি ইটালিতে পৌঁছেছিলেন; ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫,৪৭৬ জনে—বৃদ্ধি প্রায় দ্বিগুণ।
এই বৃদ্ধি কোনো প্রাকৃতিক ধারা নয়, বরং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার প্রতিফলন।
বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং বিদেশে কাজের স্বপ্নকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চোরাকারবারি নেটওয়ার্ক—সব মিলিয়ে তরুণরা এখন এই মৃত্যুপথে ঝুঁকছে।
অর্থনীতি বনাম বাঁচার আকুতি
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের পথে যাত্রার খরচ এখন গড়ে ৮–১০ লাখ টাকা।
এই অর্থ দিতে গিয়ে বহু পরিবার ঋণে ডুবে যাচ্ছে।
কিন্তু যখন দেশে টিকে থাকার সুযোগ কমে যায়, তখন ‘বাঁচা’র সংজ্ঞাই বদলে যায়—সমুদ্রপথের অনিশ্চয়তাও তখন আশার প্রতীক হয়ে ওঠে।
এ বছর ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯,১৫৬ জন অভিভাবকহীন শিশু ইটালিতে পৌঁছেছে।
সংখ্যাটি গত বছরের তুলনায় সামান্য বেশি হলেও ২০২৩ সালের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
এই শিশুদের অনেকেই পাচার চক্রের শিকার; কেউবা পরিবারের একমাত্র ভরসা হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে—অমানবিক এক বাস্তবতা, যা বাংলাদেশের সামাজিক ভাঙনকে উন্মোচিত করছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন সীমান্তে নজরদারি ও অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ কঠোর করেছে।
তবুও বাংলাদেশিদের আগমন বাড়ছে, যা প্রমাণ করে—এই যাত্রা আর কেবল অর্থনৈতিক নয়; এটি ক্রমে পরিণত হচ্ছে এক মানবিক সঙ্কেত-এ।
এই সংখ্যাগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার আয়না।
দেশ থেকে দক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শ্রমবাজারের বাস্তব সংস্কার, এবং মানবপাচার রোধে কার্যকর নীতি না থাকলে—ইউরোপমুখী এই স্রোত থামানো সম্ভব নয়।
আজ ভূমধ্যসাগরের প্রতিটি নৌকায় শুধু তরুণ শ্রমিক নয়, ভেসে যাচ্ছে এক রাষ্ট্রের বিকল্পহীনতার প্রতীক।
ইটালির উপকূলে ভেসে আসা প্রতিটি বাংলাদেশির পেছনে আছে একটি গল্প—স্বপ্ন, ব্যর্থতা, ও বেঁচে থাকার মরিয়া প্রচেষ্টা।
২০২৫ সালের এই পরিসংখ্যান শুধু ইউরোপীয় অভিবাসন নয়, বরং বাংলাদেশের সমাজ–অর্থনীতির গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি।
যদি রাষ্ট্র আজও তা না বোঝে, আগামী বছরগুলোতে ভূমধ্যসাগরের ঢেউয়ে ভেসে আসবে আরও অগণিত নামহীন বাংলাদেশি।

 
                         
         
         
        