উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বরগুনা পৌরসভার সড়কে প্রকাশ্যে চলছে টোলের নামে চাঁদা আদায়। প্রশাসনিক নীরবতা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে এক অঘোষিত ‘অর্থনৈতিক মাফিয়া নেটওয়ার্ক’।
বরগুনা পৌরসভার তিনটি প্রবেশপথে—ক্রোক ব্রিজ, পৌর বাস টার্মিনাল ও সোনাখালী এলাকায়—প্রতিদিন প্রায় অর্ধলাখ টাকা ‘টোলের নামে’ আদায় করা হচ্ছে। অথচ ২০২২ সালের এপ্রিলে উচ্চ আদালত স্পষ্টভাবে রায় দিয়েছিল, টার্মিনাল ব্যতীত কোনো সড়ক থেকে টোল আদায় বেআইনি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও একই বছরের সেপ্টেম্বরে এই আদেশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে বরগুনা পৌর প্রশাসন যেন ‘অদৃশ্য শক্তির’ ছত্রছায়ায় আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সড়ক থেকে টাকা তোলার বিরুদ্ধে নির্দেশ জারি করলেও, বাস্তবে তা কাগজেই সীমাবদ্ধ।
এই অবাধ চাঁদাবাজির ফলে আইনের শাসন ও স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।
চালকদের বক্তব্য অনুযায়ী, বরগুনা পৌর এলাকায় প্রবেশের আগে ট্রাকপ্রতি ২০০ টাকা দিতে হয়।
প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার টাকার বেশি অবৈধ টোল আদায় হচ্ছে।
বছর শেষে এই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি টাকা—যা কোনো পৌর কোষাগারে যায় না, বরং যায় “ইজারাদার” নামধারী চক্রের হাতে।
এই অর্থনৈতিক অনিয়ম শুধু পরিবহন খরচই বাড়াচ্ছে না, বরং স্থানীয় বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও ভোক্তা-ভোগান্তির অন্যতম কারণ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাজমুস সাকিবের ভাষায়,
“পৌরসভা যে টোল আদায় করছে, তা আদালতের আদেশ অমান্য করে প্রকাশ্য চাঁদাবাজি।”
পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট নুরুল আমীনও একই ইঙ্গিত দেন—“টার্মিনাল না থাকলে সেখানে টোল বৈধ নয়।”
অন্যদিকে, বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন,
“যদি এটি হয়ে থাকে, এটি বিধি-বহির্ভূত এবং অন্যায় কাজ। আমরা তদন্ত করব।”
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—তদন্তের পরও কি এই চাঁদাবাজি বন্ধ হবে, নাকি আবারও প্রশাসনিক “নজরদারির” আড়ালে বৈধতার চাদরে ঢেকে দেওয়া হবে?
টোল, ইজারা ও দুর্নীতির চক্র
পৌরসভার পক্ষ থেকে ইজারা নেওয়া ব্যক্তি সাগর জমাদ্দার দাবি করেন,
“তিনবার টেন্ডার কল হয়েছে, তিনবারই আমরা ইজারা পেয়েছি।”
কিন্তু এই ইজারার বৈধতা কোথা থেকে এলো—যখন উচ্চ আদালত স্পষ্টভাবে সড়কে টোল তোলাকে নিষিদ্ধ করেছে?
এটি মূলত প্রশাসনিক দুর্নীতির একটি জটিল রূপ, যেখানে পৌরসভা আইনকে পাশ কাটিয়ে ইজারাদারদের মাধ্যমে টাকা তোলার বৈধতার ছদ্মবেশ তৈরি করছে।
এই প্রক্রিয়া আইনের প্রতি অবজ্ঞা ও স্থানীয় সরকারের স্বচ্ছতার অভাবকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
বরগুনা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন,
“অবৈধভাবে টাকা আদায়ের কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে, জনগণের ভোগান্তিও বেড়েছে।”
সাধারণ মানুষ মনে করছেন, আইন যদি শুধুমাত্র “শক্তির কাছে নমনীয়” থাকে, তাহলে ন্যায়বিচারের আশা বৃথা।
বরগুনা এখন যেন একটি মডেল হয়ে উঠেছে—যেখানে আইনের শাসন নয়, বরং ইজারাদারের ইচ্ছাই আইন।
বরগুনা পৌরসভার এই টোল-চাঁদাবাজির ঘটনা শুধু স্থানীয় সরকারের নয়, বরং দেশের প্রশাসনিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি।
একদিকে আদালতের আদেশ, অন্যদিকে ক্ষমতাধর স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাব—এই দ্বৈরথে হারছে সাধারণ মানুষ ও আইনের মর্যাদা।
যদি সরকার সত্যিই “গুড গভর্নেন্স” বাস্তবায়নে আন্তরিক হয়, তবে বরগুনা থেকে শুরু করতে হবে — যেখানে আইন লঙ্ঘন করে উপার্জন বৈধতা পাচ্ছে, আর জনগণ হচ্ছে নীরব শিকার।
