 
                  উত্তরার বায়তুন নূর জামে মসজিদের খতিব মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমী জামায়াতের সতর্কতামূলক চিঠি জুমার মিম্বারে প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলেছেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধর্ম ও রাজনীতির সীমারেখা নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে।
রাজধানীর উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের বায়তুন নূর জামে মসজিদে গত শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) এমন এক ঘটনা ঘটেছে, যা ধর্মীয় পরিসর ও রাজনৈতিক প্রভাবের দ্বন্দ্বকে নতুনভাবে সামনে এনেছে। জুমার নামাজের আগে মিম্বারে বসে খতিব মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক প্রেরিত এক সতর্কতামূলক চিঠি প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলেছেন। তার এই প্রতিক্রিয়া সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বিস্তর আলোচনা ও বিতর্ক।
চিঠিটি স্বাক্ষর করেছিলেন উত্তরা পশ্চিম থানা জামায়াতে ইসলামী দপ্তর সম্পাদক জি. এম. আসলাম।
এতে অভিযোগ আনা হয়, গত ১০ অক্টোবরের খুতবায় খতিব জামায়াত সম্পর্কে “বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বক্তব্য দিয়েছেন।
চিঠিতে সতর্ক করা হয়, ভবিষ্যতে এমন বক্তব্য থেকে বিরত না থাকলে উদ্ভূত পরিস্থিতির দায়ভার খতিব ও মসজিদ কমিটিকেই নিতে হবে।
বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় মসজিদ কেবল ইবাদতের স্থান নয়, বরং সমাজচিন্তা ও নৈতিক দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রও বটে।
তবে এখান থেকেই যদি রাজনৈতিক বক্তব্য বা দলীয় ইঙ্গিত প্রকাশ পায়, তখন সেটি ‘নিরপেক্ষ মিম্বার’-এর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে—এমন উদ্বেগ বহুদিনের।
খতিব কাসেমীর বক্তব্যে যেমন “রোজা আর পূজা এক নয়” বা “তাওবা পড়ুন”—এসব ধর্মীয় সতর্কবাণী ছিল,
তেমনি জামায়াতের চিঠি ছিঁড়ে ফেলা এক প্রতীকী প্রতিবাদে পরিণত হয়েছে।
এটি এক অর্থে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রকাশ হলেও, অন্য অর্থে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার সূচনা করেছে।
ধর্ম ও রাজনীতির সংঘর্ষরেখা
জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরেই ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বহুবার বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
উত্তরার এই ঘটনা সেই পুরনো বিতর্কের নতুন পর্ব—যেখানে প্রশ্ন উঠছে, ধর্মীয় প্ল্যাটফর্ম কি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবমুক্ত থাকতে পারছে?
অন্যদিকে, খতিবের প্রকাশ্য প্রতিবাদ ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’র এক নতুন রূপ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
তিনি মূলত ঘোষণা করেছেন, মসজিদে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের নির্দেশনা চলবে না।
চিঠিটির অনুলিপি পাঠানো হয়েছিল আর্মি ক্যাম্প, ডিএমপি উত্তরা বিভাগ, থানার ওসি এবং সেক্টর কল্যাণ সমিতির সভাপতি-সম্পাদক বরাবর—
যা স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয়, জামায়াত বিষয়টিকে কেবল ধর্মীয় নয়, প্রশাসনিক চাপের দিক থেকেও প্রভাবিত করতে চেয়েছিল।
কিন্তু খতিব যখন প্রকাশ্যে সেই চিঠি ছিঁড়ে ফেলেন এবং মুসল্লিরা ‘নারায়ে তাকবির’ ধ্বনি দেন, তখন বিষয়টি সামাজিক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে।
এই ঘটনার মাধ্যমে মূলত তিনটি বার্তা স্পষ্ট হয়—
মসজিদ কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নয়।
ধর্মীয় নেতারা যদি সাহসিকতার সঙ্গে নিরপেক্ষতা রক্ষা করেন, জনগণের আস্থা বাড়ে।
রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হস্তক্ষেপ করলে সমাজে বিভাজন বাড়ে।
উত্তরার বায়তুন নূর জামে মসজিদের ঘটনাটি একটি বড় প্রশ্ন সামনে এনেছে—বাংলাদেশের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত?
যেখানে একদিকে ইসলামি দলগুলো ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে জনমত তৈরি করতে চায়,
সেখানে অন্যদিকে একদল আলেম চেষ্টা করছেন মসজিদকে রাজনীতিমুক্ত রাখার।
মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমীর চিঠি ছিঁড়ে ফেলার পদক্ষেপটি তাই শুধু এক ব্যক্তির সাহসিকতা নয়, বরং ধর্মীয় পরিসরে স্বাধীন চিন্তার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।

 
                         
         
         
        