ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অন্তর্বর্তী সরকারকে ১২ দফা সুপারিশ দিয়েছে—আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার থেকে র্যাব বিলুপ্তি, আইন সংস্কার ও গুমের অপরাধীকরণ পর্যন্ত। চিঠিটি ড. ইউনূস সরকারের মানবাধিকার অগ্রগতি প্রশংসা করলেও নিরাপত্তা খাতের সংস্কারকে জরুরি বলেছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার যৌথ খোলাচিঠি শুধু মানবাধিকার সংক্রান্ত পরামর্শ নয়—বরং এটি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির পথনির্দেশক এক গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সংকেত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই চিঠিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের গৃহীত প্রাথমিক সংস্কার ও স্বাধীনতার পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগের প্রশংসা করলেও, একইসঙ্গে তারা এক গভীর কাঠামোগত পরিবর্তনের রূপরেখা তুলে ধরেছে এবং ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অন্তর্বর্তী সরকারকে ১২ দফা সুপারিশ দিয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, “২০২৬ সালের নির্বাচন যেন সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়, তার জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা, জবাবদিহি ও নিরাপত্তা খাতের সংস্কার জরুরি।”
এই বক্তব্য স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার অবস্থা ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
১২ দফা সুপারিশের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত প্রস্তাবটি হলো আওয়ামী লীগের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।
সংস্থাগুলোর মতে, কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমে সামগ্রিক নিষেধাজ্ঞা গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদকে ক্ষুণ্ণ করে এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও বাড়ায়।
এই দাবি শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্ন নয়—এটি বর্তমান সরকারের গণতান্ত্রিক সুনাম ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার মানে হবে, অন্তর্বর্তী সরকার নিজেকে প্রতিশোধের রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখছে—যা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে ইতিবাচক বার্তা দেবে।
চিঠিতে সবচেয়ে কঠিন ও বিতর্কিত সুপারিশগুলোর একটি হলো র্যাব বিলুপ্তি এবং ডিজিএফআই-এর ক্ষমতা সীমিত করা।
গত এক দশকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় র্যাবের ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হয়েছে, যার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
অতএব, সংস্থাগুলোর এই আহ্বানকে আন্তর্জাতিক জনমতের প্রতিফলন হিসেবেই দেখা উচিত।
এছাড়া সেনাবাহিনীর সদস্যদের বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে প্রত্যাহারের প্রস্তাব ভবিষ্যৎ বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার দিকনির্দেশনা দেয়—
যা বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের একটি কাঠামোগত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু।
গুম, বিচারহীনতা ও মৃত্যুদণ্ড স্থগিতের আহ্বান
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, “গুমের অপরাধকে আন্তর্জাতিক মানে সংজ্ঞায়িত করা” এবং ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ’ পাস করা এখন সময়ের দাবি।
তবে তারা মৃত্যুদণ্ড বিলোপ না করে কেবল কার্যকর স্থগিতাদেশ চেয়েছে—যা বাস্তববাদী অবস্থান হিসেবে দেখা যায়।
একইসঙ্গে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সহিংসতা ও আগের শাসনামলে সংঘটিত গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচার দাবি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের অবস্থানকে পুনর্ব্যক্ত করেছে।
২০২৫ সালের সাইবার সিকিউরিটি অধ্যাদেশ, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সংশোধনের আহ্বানটি মূলত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার অংশ।
বিশেষ করে সাংবাদিক ও ডিজিটাল অ্যাক্টিভিস্টদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য এই দাবি করা হয়েছে।
এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে—মানবাধিকার শুধু নিরাপত্তা নয়, বরং তথ্য ও মতপ্রকাশের অধিকারও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ।
চিঠিতে রোহিঙ্গা সংকটের মানবিক দিক তুলে ধরে জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন বন্ধ ও শিক্ষা ও চলাচলের স্বাধীনতা বৃদ্ধির আহ্বান জানানো হয়েছে।
পাশাপাশি এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর সংস্কারের মাধ্যমে সিভিল সোসাইটি যেন সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্তভাবে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এটি দেশের মানবাধিকার ইকোসিস্টেম পুনর্গঠনের মূল চাবিকাঠি হতে পারে।
এই ১২ দফা সুপারিশকে কেউ কেউ “অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিমালা পরিপূরক আন্তর্জাতিক গাইডলাইন” হিসেবে দেখছেন, আবার অনেকে এটিকে “বাহ্যিক চাপের রাজনৈতিক বার্তা” বলেও মন্তব্য করছেন।
তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই—বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিকভাবে নজরকাড়া এক রূপান্তরের পথে।
ড. ইউনূসের সরকার যদি এই সুপারিশগুলোর মধ্যে থেকে বাস্তবসম্মত অংশগুলো বাস্তবায়নে সক্ষম হয়,
তবে ২০২৬ সালের নির্বাচন শুধু বাংলাদেশের গণতন্ত্র নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকার ধারাকেও নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
