 
                  কক্সবাজার রেলস্টেশন পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। রেলওয়ের অদক্ষতা ঢাকতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া কি যৌক্তিক?
বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ—যা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। প্রায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্পে দেশের প্রথম আন্তর্জাতিকমানের রেলস্টেশন গড়ে ওঠে কক্সবাজারে। ছয়তলা বিশিষ্ট এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাটি উদ্বোধনের সময় দেশজুড়ে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু মাত্র দুই বছর যেতে না যেতেই এই স্টেশন এখন অচল অবকাঠামোর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ভবনে আজ যাত্রীসেবা নেই, দোকান নেই, কার্যকর ফুড কোর্ট নেই, এমনকি শৌচাগারও ব্যবহার অনুপযোগী।
রাতের বেলায় স্টেশন চত্বর অন্ধকারে ডুবে থাকে, হাতে গোনা কিছু যাত্রী ছাড়া কেউই সেখানে যায় না।
আর এই ব্যর্থতাকে ঢাকতে এখন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ “তৃতীয় পক্ষের হাতে” স্টেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাস্তবে সেই তৃতীয় পক্ষ হবে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান, এমনটাই নিশ্চিত করেছে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের দাবি—এই আধুনিক স্টেশন পরিচালনায় মাসে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা ব্যয় হবে কেবল ইউটিলিটি বিলেই।
এত ব্যয় বহনের সামর্থ্য না থাকায় এখন তারা বিদেশি অভিজ্ঞতার আশ্রয় নিতে চাইছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—
রাষ্ট্রীয় অর্থে নির্মিত এমন প্রকল্প কেন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালানো যাচ্ছে না?
কেন দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে এককভাবে যোগ্য বলে মনে করা হচ্ছে না?
রেলওয়ে মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মধ্যে ইতিমধ্যেই তিনবার চিঠি চালাচালি হয়েছে দরপত্র আহ্বানের জন্য।
এই দরপত্রে শর্ত দেওয়া হয়েছে—
শুধুমাত্র পাঁচতারকা হোটেল পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে এমন প্রতিষ্ঠানই অংশ নিতে পারবে, এবং দরপত্রটি হবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের।
দেশীয় প্রতিষ্ঠান চাইলে কেবল বিদেশিদের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার (JV) আকারে অংশ নিতে পারবে।
অর্থাৎ, দেশের রেলওয়ে ব্যবস্থাপনা এখন নিজেরাই স্বীকার করছে যে তারা অযোগ্য—এমন বার্তাই জনমনে তৈরি হচ্ছে।
চীনা নির্মাণ থেকে বিদেশি ব্যবস্থাপনা—দেশীয় সক্ষমতা কোথায়?
উল্লেখ্য, প্রকল্পের শুরু থেকেই এর নির্মাণকাজ ছিল চীনের দুই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান—সিআরইসি (CREC) ও সিসিইসিসি (CCECC)-এর হাতে।
বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডও সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে, কিন্তু মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল বিদেশিদের হাতে।
এখন পরিচালনাও যদি বিদেশিদের হাতে যায়, তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়—
আমরা কি কেবল নির্মাণের অর্থ জোগান দেব, আর সবকিছু বিদেশিরাই চালাবে?
তবে দেশীয় দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরি হবে কবে?
বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. হাদিউজ্জামান মনে করেন, উদ্যোগ ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই এমন অপচয় হচ্ছে।
তার মতে, বিদেশিদের ওপর অন্ধ নির্ভরতার পরিবর্তে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে সক্ষম করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি ছিল।
এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল অর্থনৈতিক নয়—এটি নীতিগত প্রশ্নও।
কারণ, একের পর এক রাষ্ট্রীয় স্থাপনা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিলে দেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব ও প্রশাসনিক আত্মনির্ভরতা—
দুটিই প্রশ্নের মুখে পড়ে।
রেলওয়ের বিদেশিনির্ভর সিদ্ধান্ত হয়তো সাময়িক আর্থিক স্বস্তি দেবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি রাষ্ট্রীয় অদক্ষতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটাবে।
কক্সবাজার রেলস্টেশন কেবল একটি স্থাপনা নয়—এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অবকাঠামো নীতির প্রতিফলন।
যদি আমরা প্রতিটি ব্যর্থ প্রকল্প বিদেশিদের হাতে হস্তান্তর করি, তবে দেশীয় দক্ষতা কখনোই তৈরি হবে না।
রেলওয়ের এই মনোভাব তাই কেবল ব্যবস্থাপনার সংকট নয়—এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতিনির্ভরতার এক গভীর সতর্কবার্তা।
রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো পরিচালনায় বিদেশিদের ওপর নির্ভরতা যত বাড়বে, ততই দুর্বল হবে বাংলাদেশের নিজস্ব সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস।
কক্সবাজার রেলস্টেশন এখন সেই দুর্বলতার প্রতীক—যার দায় কেবল প্রশাসনিক নয়, নীতিগতও।

 
                         
         
         
        