 
                  আইএমএফ জানিয়েছে, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত বাংলাদেশের ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড় করা হবে না। এই অবস্থান অর্থনৈতিক যুক্তি না রাজনৈতিক চাপ—তা নিয়েই বিশ্লেষণ।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)-এর সর্বশেষ অবস্থান বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির সংযোগকে নতুনভাবে আলোচনায় এনেছে। সংস্থাটি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে—নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত তারা ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড় করবে না।
এটি নিছক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়; বরং আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে একটি পরোক্ষ রাজনৈতিক বার্তা বলেই মনে করছেন অর্থনীতি–রাজনীতি বিশ্লেষকেরা।
ওয়াশিংটনে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভার সাইডলাইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের বৈঠকে এই অবস্থান প্রকাশ করা হয়।
আইএমএফের বার্তা স্পষ্ট—নতুন নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে সংস্কার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতার লিখিত প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরেই তারা অর্থ ছাড় করবে।
অর্থাৎ, কেবল বর্তমান সরকারের বাস্তবায়ন নয়, ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রশাসনও যেন একই পথে থাকে, তা নিশ্চিত করতে চায় সংস্থাটি।
বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, আইএমএফের এই অবস্থান আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের ওপর কৌশলগত চাপ প্রয়োগের অংশ।
নির্বাচনের আগে কিস্তি বন্ধ রাখলে সরকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় সংকটে পড়তে পারে।
তবে আইএমএফের দৃষ্টিতে এটি হতে পারে “policy continuity” বা নীতিগত ধারাবাহিকতা নিশ্চিতের একটি নিরাপদ পন্থা—বিশেষত যখন নির্বাচনের পর প্রশাসনিক পরিবর্তনের আশঙ্কা থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের বক্তব্যে একটি আত্মবিশ্বাসী সুর শোনা গেছে—
“আইএমএফের অর্থ এখন বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য নয়। রিজার্ভ ভালো, ডলারের বাজার স্থিতিশীল।”
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন—বাংলাদেশ কঠোর শর্তে আর ঋণ নেবে না।
এই বক্তব্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকভাবেও একটি বার্তা দেয়—বাংলাদেশ এখন আর “খাদের কিনারায়” নেই।
আইএমএফের চাপ ও জ্বালানি সংস্কার
আইএমএফ অতীতেও অনুরূপ কৌশল নিয়েছে। ২০০১ ও ২০২২ সালে তারা ঋণের শর্ত বাস্তবায়নে চাপ প্রয়োগ করেছিল।
বিশেষত ২০২২ সালে ঋণের শর্ত পূরণ করতে সরকারকে তেল, গ্যাস ও সারের দাম বৃদ্ধি করতে হয়েছিল, যার ফলে মূল্যস্ফীতিতে ব্যাপক ধাক্কা লেগেছিল।
এবারও সংস্থাটি হয়তো সংস্কারের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে একই রকম কৌশল নিচ্ছে—তবে এবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশের রিজার্ভ এখন ৩ হাজার ২১৪ কোটি ডলার, রেমিট্যান্সে ১৬% বৃদ্ধি, এবং রপ্তানি আয় স্থিতিশীল।
এমন প্রেক্ষাপটে আইএমএফের কিস্তি বিলম্বিত হলেও অর্থবাজারে তাৎক্ষণিক ধাক্কার আশঙ্কা নেই।
বরং এই আত্মবিশ্বাসই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর শর্ত পুনর্বিবেচনায় সাহস জোগাচ্ছে।
২৯ অক্টোবর আইএমএফের একটি মিশন ঢাকায় আসছে, যারা দুই সপ্তাহ অবস্থান করে সরকারি সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে এবং পরে ওয়াশিংটনে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে।
এই প্রতিবেদনের ওপরই নির্ভর করবে—বাংলাদেশ ডিসেম্বরে ষষ্ঠ কিস্তির ৮০ কোটি ডলার পাবে কি না।
আইএমএফের অবস্থান নিছক অর্থনৈতিক নয়—এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক আস্থার সঙ্গে যুক্ত।
বাংলাদেশ এখন এক দ্বিধাবিভক্ত পথে দাঁড়িয়ে—
একদিকে আর্থিক শৃঙ্খলা ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, অন্যদিকে সার্বভৌম সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা।
এই ভারসাম্য বজায় রাখাই হতে পারে আগামী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

 
                         
         
         
        