সেনানিবাসে পনের মাস ধরে চলা অদৃশ্য ক্ষমতার লড়াইয়ের অবসান ঘটিয়ে ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা’ দেখিয়ে শীর্ষে উঠলেন জেনারেল ওয়াকার। সেনাবাহিনীর ভেতরের বিভাজন, ইউনূস সরকারের সঙ্গে অদ্ভুত সহাবস্থান ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার ভবিষ্যৎ কি?
বাংলাদেশের সেনানিবাসে বিগত পনের মাস ধরে চলছিল এক অদৃশ্য কিন্তু নির্মম ক্ষমতার লড়াই—যাকে বিশ্লেষকরা বলছেন “ঠাণ্ডা যুদ্ধের নতুন সংস্করণ”। একদিকে ছিল বিগত সরকারের পক্ষে থাকা অংশ, অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবিত বলয় এবং তাদের মধ্যবর্তী অবস্থানে ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার—যিনি শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছেন “আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা” নামের এক কৌশলগত অস্ত্র প্রয়োগ করে। ২২ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের জারিকৃত ওয়ারেন্টে অভিযুক্ত ২৫ জন সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ১৫ জনকে আদালতে সোপর্দ করা—একটি বার্তা: সেনাবাহিনী আর রাজনৈতিক আশ্রয়ে নয়, আইনি শৃঙ্খলার ছত্রছায়ায় চলবে।
কিন্তু এই ‘আইনানুগতা’ই বাস্তবে ওয়াকারের দাবাবোর্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাল।
ওয়াকারের কৌশল: আড়াই চালে রাজা খাওয়া
সেনাপ্রধান ওয়াকার চাইলে সেনা আইনের আশ্রয়ে এই মামলা স্থগিত রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
এর অর্থ—তিনি পরিস্থিতি “এড়াতে চাননি”, বরং শত্রুপক্ষকে ‘চেসবোর্ডে ফাঁদে ফেলে’ তাদের পাল্টা চালের সুযোগই রাখলেন না।
বিগত সরকারপন্থী, র্যাডিক্যাল ইসলামপন্থী ও বিদেশপন্থী কর্মকর্তাদের মধ্যে চলা ক্ষমতার টানাপোড়েনে এখন স্পষ্ট: ওয়াকার প্রতিষ্ঠা করলেন নিজেকে সেনাবাহিনীর একমাত্র ‘নিয়ন্ত্রক কর্তৃত্ব’ হিসেবে।
ওয়াকার বনাম ইউনূস: দ্বন্দ্ব নাকি সমঝোতার মুখোশ?
প্রথমে মনে হয়েছিল জেনারেল ওয়াকার ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে সম্পর্ক ‘শীতল’।
কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। ইউনূসের সরকার ডিপস্টেটের প্রক্সি—এবং সেই পরিকল্পনায় ওয়াকার ছিলেন প্রয়োজনীয় অংশ।
ইউনূস ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কার্ড খেলছেন, আর ওয়াকার সেই কার্ডকে আড়াল করছেন “আইনের শাসন” আর “স্থিতিশীলতার” মিথ দিয়ে।
দুজনের লক্ষ্য অভিন্ন: ভারতকে আস্থায় রাখা, পশ্চিমা ব্লকের অনুকূলে থাকা, এবং দেশীয় বিরোধী শক্তিকে ‘ম্যানেজ’ রাখা।
সেনানিবাসে বিভাজন ও অন্তর্দ্বন্দ্ব
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর ভেতরে তৈরি হয়েছে গভীর বিভাজন।
- একাংশ মনে করছে, ওয়াকার সেনাবাহিনীর সম্মান রক্ষায় কাজ করেছেন।
- অন্য অংশের দাবি, তিনি আসলে ইন্টেরিম সরকারের হাতিয়ার হয়ে কাজ করছেন।
১৫ সেনা কর্মকর্তাকে আদালতে সোপর্দ করার পর থেকে অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ ও সন্দেহ বাড়ছে।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর ঐক্য ও চেইন অব কমান্ডে “স্থায়ী ফাটল” তৈরি হবে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি ওয়াকারের আগ্রহ?
ওয়াকার বারবার বলেছেন—“তার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই।” কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এই কথাটির পুনরাবৃত্তিই তার উচ্চাভিলাষের ইঙ্গিত।
যদি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত নির্বাচন স্থগিত হয় এবং রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হয়, তবে ওয়াকার-ইউনূস জুটি একটি নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট তৈরি করতে পারে—যেখানে সেনাবাহিনী, এনসিপি ও জামাতপন্থী উপদলগুলোর মধ্যে একটি “মিলিশিয়া কাঠামো” গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বলে কূটনৈতিক মহল মনে করছে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ও সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি
বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনী সবসময়ই ক্ষমতার কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭৫ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত একাধিকবার তারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সরকার পরিবর্তনে জড়িত ছিল।আজও সেই একই প্রবণতা ফিরে এসেছে—তবে এবার “আইনের প্রতি শ্রদ্ধা” ও “নিরপেক্ষ প্রশাসন” নামের এক নতুন মুখোশে।
১৫ কর্মকর্তাকে জেলে পাঠিয়ে ওয়াকার হয়তো সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু বাস্তবে এই সিদ্ধান্তই হয়তো সেনাবাহিনীকে আরও বিভক্ত করবে।
সামনে কী আসছে?
জেনারেল ওয়াকার আপাতদৃষ্টিতে জয়ী হলেও এই জয় “দাবাবোর্ডের এক পর্ব” মাত্র। ইন্টেরিম সরকার, সেনানিবাস ও বিদেশি কূটনীতিক বলয়ের জটিল সমীকরণ এখনো অমীমাংসিত।
যদি সেনা-পুলিশ কর্মকর্তাদের জেলে পাঠানো হয় বৃহত্তর রাজনৈতিক পুনর্গঠনের প্রস্ত্ততি হিসেবে, তবে বাংলাদেশ এক নতুন অজানা পথে হাঁটছে—যার গন্তব্য হতে পারে ইরাক বা লিবিয়ার মতো বিভক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা।
জাতির প্রশ্ন এখন একটাই—
‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা’ কি সত্যিই ন্যায়বিচারের প্রতীক, নাকি ক্ষমতার দাবাবোর্ডে ওয়াকারের সুনিপুণ চাল?
