ভারত বাংলাদেশ থেকে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ আমদানি বন্ধ করেছে। এর পেছনে রয়েছে আর্থিক জটিলতার পাশাপাশি সামরিক অবিশ্বাস ও বাংলাদেশের ইন্টারনেট অবকাঠামোর মারাত্মক অবনতি।
দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো বাংলাদেশের সরবরাহকৃত ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করছিল। বাংলাদেশের সাবমেরিন কেবল সংযোগের মাধ্যমে এ ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করে আসছিল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল)। কিন্তু হঠাৎ করেই ভারত ঘোষণা দিয়েছে— তারা আর বাংলাদেশ থেকে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ আমদানি করবে না। নিজেদের স্যাটেলাইট লিংক ও অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তারা এখন সেই প্রয়োজন মেটাবে।
ভারতীয় পক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী, এ সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে মূলত আর্থিক ও বিলিং জটিলতা।
কিন্তু বাস্তবে এর পেছনে রয়েছে আরও দুইটি গভীর রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কারণ— সামরিক অবিশ্বাস এবং বাংলাদেশের ইন্টারনেট অবকাঠামোর অবনতি।
ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামরিক ভূমিকা ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষণে সন্দেহের জায়গা তৈরি করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন ভারতের জন্য “অবিশ্বাসের ক্ষেত্র” হয়ে উঠছে— এমনটি বলছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা মহলে এখন ধারণা স্পষ্ট হচ্ছে যে, বাংলাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে চীনা প্রভাব বেড়ে যেতে পারে।
তাই ডিজিটাল ও সামরিক নির্ভরতা কমানো এখন ভারতের কৌশলগত অগ্রাধিকার।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানো তাদের জন্য একধরনের “ডিজিটাল ডি-রিস্কিং” প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের গুণগত মান গত এক বছরে নাটকীয়ভাবে কমে গেছে।
সাবমেরিন কেবলের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিতভাবে না হওয়ায় ডেটা ট্রান্সমিশনে বিলম্ব ও বিঘ্ন বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাবমেরিন কেবল অবকাঠামো সচল রাখতে নিয়মিতভাবে নোড আপডেট, নতুন কেবল সেগমেন্ট সংযোগ এবং পুরোনো লিংক সংস্কার অপরিহার্য।
কিন্তু গত ১৪ মাসে কোনো কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম হয়নি, যার ফলে বাংলাদেশে ইন্টারনেট স্পিড ও স্থিতিশীলতা উভয়ই ক্রমাগত নিম্নগামী।
অনেক দেশীয় আইটি প্রতিষ্ঠান তাদের সার্ভার ও হোস্টিং সেবা বিদেশে সরিয়ে নিচ্ছে, যা দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা ও ডেটা সার্বভৌমত্বের জন্য একটি উদ্বেগজনক সঙ্কেত।
ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার সংকট
এক সময় “ডিজিটাল বাংলাদেশ” ছিল জাতীয় গর্বের প্রতীক।
কিন্তু সেই অবকাঠামো আজ হুমকির মুখে।
রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি, দক্ষ জনবল সংকট এবং নীতিগত অনিশ্চয়তা এখন দেশের আইসিটি খাতকে দুর্বল করে ফেলছে।
ভারতের ব্যান্ডউইথ আমদানি বন্ধের ঘটনা সেই দুর্বলতার এক প্রকাশ্য প্রতিফলন।
বাংলাদেশ যদি শিগগিরই তার ইন্টারনেট অবকাঠামো পুনর্গঠন না করে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্ট বা অংশীদার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
ভারতের এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি বাণিজ্যিক পদক্ষেপ নয়— এটি দক্ষিণ এশিয়ার ডিজিটাল ভূরাজনীতিতে একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত অবনতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মিলিয়ে এই অঞ্চলে দেশটির অবস্থান এখন আগের চেয়ে অনেক দুর্বল।
এই সংকটের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উচিত হবে— নিজস্ব সাবমেরিন কেবল ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, এবং আইসিটি খাতে নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
না হলে ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব হারানোর ঝুঁকি থেকে আর রক্ষা পাওয়া যাবে না।
