অভিনেত্রী ও গায়িকা মেহের আফরোজ শাওনের মা এবং সাবেক এমপি তহুরা আলী আর নেই। রাজনীতি, শিক্ষা ও সমাজসেবায় অবদান রাখা এই নারী ছিলেন নীরব অথচ প্রভাবশালী এক আলোকবর্তিকা।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে কিছু নাম থাকে যারা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু না হয়েও সমাজে গভীর ছাপ রেখে যান। বেগম তহুরা আলী ছিলেন এমনই একজন। অভিনেত্রী ও সংগীতশিল্পী মেহের আফরোজ শাওনের মা, কিন্তু তার পরিচয় শুধু মাতৃত্বে সীমাবদ্ধ নয়—তিনি ছিলেন একজন সংসদ সদস্য, শিক্ষিকা, উদ্যোক্তা এবং সর্বোপরি এক মানবিক মননের নারী।
বৃহস্পতিবার ভোরে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশের এক নারী রাজনীতিক প্রজন্মের এক অধ্যায় শেষ হলো।
বয়স হয়েছিল ৭২ বছর (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জামালপুর–শেরপুর আসন থেকে এবং ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ফেনী থেকে তিনি জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে দায়িত্ব পালন করেন।
সংসদে তার উপস্থিতি ছিল দৃঢ় অথচ মৃদু—তিনি কখনো আক্রমণাত্মক ছিলেন না, বরং যুক্তি ও নীতির জায়গা থেকেই মত দিতেন।
রাজনীতির বাইরে তহুরা আলী ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজে।
পরবর্তীতে ব্যবসায়িক নেতৃত্বেও তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন—
সিটিজেন মার্কেটিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন।
অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান,
“গভীর শোকের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আমাদের প্রিয় মা বেগম তহুরা আলী মা মারা গেছেন।
পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা যেন তাকে মাফ করে দেন।”
একজন সংসদ সদস্যের মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গন শোকাহত হলেও, একজন মায়ের প্রস্থান যে কন্যার জন্য কেমন গভীর শূন্যতা রেখে যায়,
তা বোঝা যায় শাওনের এই কথাগুলোতে।
জানাজা ও শেষ শ্রদ্ধা
মরহুমার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে দুটি স্থানে—
আসরের পর গুলশান আজাদ মসজিদে এবং মাগরিবের পর তেজগাঁও রহিম মেটাল সেন্ট্রাল মসজিদে।
এরপর তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।
তহুরা আলী ছিলেন সেই প্রজন্মের নারী রাজনীতিকদের একজন যারা শিক্ষা, আত্মনির্ভরতা ও শালীনতার মাধ্যমে রাজনীতিকে এক মানবিক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন।
তিনি আলোচনায় আসতে ভালোবাসতেন না, বরং কাজের মধ্য দিয়েই নিজের পরিচয় তুলে ধরতেন।
সংসদীয় বিতর্ক হোক বা কলেজের ক্লাসরুম—তাঁর কথায় যুক্তি, ভদ্রতা ও এক ধরনের শুদ্ধতা ছিল যা আজকের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজজীবনে নারীর অংশগ্রহণকে সমৃদ্ধ করেছেন যেসব নারী, তহুরা আলী তাদের অন্যতম।
তার জীবনের পরিসমাপ্তি মানে কেবল একজন রাজনীতিকের মৃত্যু নয়, বরং এক মৃদু কিন্তু প্রভাবশালী মানবিক আলোর নিভে যাওয়া।
তহুরা আলীর জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—একজন নারী রাজনীতিক, শিক্ষিকা ও মা একই সঙ্গে দেশের জন্য কতটা ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারেন।
তাঁর আত্মা শান্তিতে থাকুক, আর তাঁর রেখে যাওয়া মূল্যবোধ হোক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার আলো।
