ভারত যখন চেনাব ও ইন্দাসে নতুন বাঁধ নির্মাণে ব্যস্ত, তখন গঙ্গা ও তিস্তা চুক্তি নিয়েও তৈরি হচ্ছে নতুন উত্তেজনা। দক্ষিণ এশিয়ার জলবণ্টন রাজনীতিতে এবার জলই হয়ে উঠছে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অস্ত্র।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে “জল” এখন সবচেয়ে জটিল ও কৌশলগত অস্ত্রে পরিণত হচ্ছে। একদিকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ঐতিহাসিক Indus Water Treaty কার্যত ভেঙে পড়ার পথে, অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশের গঙ্গা জল চুক্তি ২০২৬ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হতে চলেছে। সব মিলিয়ে, এ অঞ্চলের নদীব্যবস্থাকে ঘিরে শুরু হয়েছে এক নীরব কিন্তু গভীর “জলযুদ্ধ”।
ভারত সম্প্রতি চেনাব ও ইন্দাস নদীর ওপর নতুন দুটি বৃহৎ বাঁধ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা Indus Water Treaty (1960)-এর মূল ধারার পরিপন্থী।
পাকিস্তান ইতিমধ্যে বিষয়টি আন্তর্জাতিক সালিসে তুলেছে, কিন্তু ভারতের অবস্থান স্পষ্ট—“আমরা আমাদের অধিকারভুক্ত জল নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করব।”
এমন অবস্থান স্পষ্টতই পাকিস্তানের জন্য এক কূটনৈতিক ও জলনৈতিক (hydro-political) চাপের কৌশল।
এর সঙ্গে আফগানিস্তানের কুনার নদীতে নতুন বাঁধ নির্মাণ যোগ হওয়ায় পাকিস্তানের পানিসঙ্কট এখন জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে রূপ নিচ্ছে।
বাংলাদেশ-ভারতের গঙ্গা জল চুক্তি ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত হয়, যার মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে।
চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কা ব্যারাজ থেকে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু এখন সেই ভারসাম্য ভেঙে পড়ছে—বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ তিস্তা নদী উন্নয়ন প্রকল্প চীনের সহায়তায় বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দিয়েছে।
ভারতের কূটনৈতিক মহল এটিকে “চীনা প্রভাবের জলীয় প্রবেশ” হিসেবে দেখছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের নীতিনির্ধারকরা গঙ্গা ও তিস্তা উভয় চুক্তি পুনর্বিবেচনা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর প্রবাহ শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এটি এখন নিরাপত্তা, বাণিজ্য, এমনকি ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের হাতিয়ার।
- ভারত ইন্দাসে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পাকিস্তানকে চাপে রাখছে।
- আফগানিস্তান নিজস্ব পানি নিয়ন্ত্রণে এনে স্বাধীন কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছে।
- বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে তিস্তা প্রকল্পে গেলে ভারত তার “উত্তরাঞ্চলীয় নদী কৌশল” পুনর্গঠন করবে।
এই তিনটি উদাহরণই দেখায়, জল এখন দক্ষিণ এশিয়ার নতুন তেল—যে তেলের ওপর নির্ভর করছে খাদ্যনিরাপত্তা, শিল্পায়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতি।
সামনে কী?
২০২৬ সালের পর যদি গঙ্গা জল চুক্তি নবায়ন না হয়, তাহলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল আরও পানিশূন্য হয়ে পড়বে—বিশেষত পদ্মা ও গড়াই অববাহিকার কৃষি ও মৎস্য খাত।
অন্যদিকে, ভারতও আন্তর্জাতিক ইমেজ সংকটে পড়বে, কারণ গঙ্গা হলো সীমান্ত অতিক্রমকারী একটি আন্তর্জাতিক নদী,
যার প্রবাহ একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের “জল কূটনীতি” এখন এক নতুন ধাপে প্রবেশ করছে—
যেখানে প্রতিবেশী সম্পর্কের মাপকাঠি হবে না আর রাজনীতি বা বাণিজ্য, বরং নদীর প্রবাহ ও বাঁধের গেট।
দক্ষিণ এশিয়ায় জল এখন শুধুই জীবনধারার উৎস নয়, এটি হয়ে উঠছে রাষ্ট্রীয় কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু।
ভারত যদি গঙ্গা ও তিস্তা চুক্তি বাতিলের পথে এগোয়, তবে তা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সমগ্র অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক স্থিতির জন্য এক নতুন সঙ্কটের সূচনা করবে।
এক সময় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যেমন শীতল যুদ্ধ হয়েছিল, এখন হয়তো শুরু হতে যাচ্ছে “জল নিয়ন্ত্রণ যুদ্ধ”—
যার প্রথম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছে ভারতের নদী নীতিতেই।
