ঢাকা বিমানবন্দরে পাকিস্তানের জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার লাগেজে পাওয়া যায় ডামি অ্যাসল্ট রাইফেল। প্রটোকল ভঙ্গ না কূটনৈতিক অসতর্কতা—তদন্তে নিরাপত্তা সংস্থা।
ঢাকা, ২৯ অক্টোবর:
চার দিনের সরকারি সফর শেষে দেশ ছাড়ার মুহূর্তে এক বিব্রতকর ঘটনার মুখে পড়লেন পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁর লাগেজ থেকে একটি ডামি অ্যাসল্ট রাইফেল বা নকল রাইফেল উদ্ধার করেছে বাংলাদেশি নিরাপত্তা সংস্থা।
ঘটনাটি ঘটে গত ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিমানবন্দরের সিআইপি গেটে, যখন অতিথিদের লাগেজ স্ক্যান করা হচ্ছিল।
সিআইপি গেটে ‘ভারী লাগেজ’ ঘিরে তৎপরতা
জেনারেল মির্জা, তাঁর স্ত্রী ও তিন সহযোগী কর্মকর্তা এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ইকে-৫৮৭ ফ্লাইটে দুবাই হয়ে পাকিস্তানে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে লাগেজ স্ক্যানের সময় একটি ভারী প্যাকেজ নিরাপত্তা কর্মীদের নজরে আসে।
ইলেকট্রনিক স্ক্যানারে এটি অস্ত্রসদৃশ আকৃতি প্রদর্শন করায় সঙ্গে সঙ্গে তল্লাশি শুরু হয়।
প্যাকেট খুলে দেখা যায়, ভেতরে একটি স্মারক রাইফেল, যা উপহারের মোড়কে রাখা ছিল।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘স্মারক রাইফেল’ উপহার
তদন্তে জানা যায়, ওই ডামি রাইফেলটি কোনো কার্যকর অস্ত্র নয়।
এটি একটি ৭.৬২ মিমি বিডি-০৮ মডেলের স্মারক রাইফেল, যাতে কোনো ফায়ারিং পিন বা গোলাবারুদ ধারণের অংশ নেই।
সামরিক সূত্র জানিয়েছে, ২৬ অক্টোবর জেনারেল মির্জার সম্মানে আয়োজিত বৈঠকে
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান এই রাইফেলটি স্মারক হিসেবে উপহার দেন।
তবে প্রোটোকল অনুযায়ী, যেকোনো অস্ত্রসদৃশ বস্তু—যদিও নকল বা অকার্যকর হলেও—বিমানবন্দর দিয়ে বহনের আগে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB) এবং সংশ্লিষ্ট শুল্ক ও নিরাপত্তা বিভাগকে লিখিতভাবে অবহিত করা বাধ্যতামূলক।
কিন্তু এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।
কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও প্রটোকল ভঙ্গের বিতর্ক
ঘটনার পর মুহূর্তেই বাংলাদেশের সামরিক নিরাপত্তা ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় বৈঠক হয়।
সেখানে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা জানান—“এটি শুধুমাত্র স্মারক, কার্যকর নয়।”তবুও বিমানবন্দর নিরাপত্তা নিয়ম অনুযায়ী, জেনারেলের লাগেজ থেকে সেটি সাময়িকভাবে আটক করা হয় এবং পরবর্তীতে কূটনৈতিক নোটের মাধ্যমে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়।
তবে ঘটনাটি নিয়ে কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে—
এত উচ্চ পর্যায়ের সফরের ক্ষেত্রে এই ধরনের অসতর্কতা কীভাবে ঘটলো?
আরও বড় প্রশ্ন—
বাংলাদেশ বা পাকিস্তান—দুই দেশের পক্ষ থেকেই কেন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে আগাম অবহিত করা হলো না?
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি “প্রোটোকল মিসকমিউনিকেশন”-এর স্পষ্ট উদাহরণ।
একজন সামরিক জেনারেল যখন অন্য রাষ্ট্রের আতিথেয়তা শেষে ফেরেন, তখন লাগেজ তালিকা ও উপহারসমূহ আগে থেকেই নিরাপত্তা দপ্তরের নথিতে সংযুক্ত থাকে।
এই ঘটনার ফলে উভয় দেশের প্রটোকল অফিস ও নিরাপত্তা সংস্থা বিব্রত অবস্থায় পড়ে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষণ: প্রতীক না প্রতারণা?
ডামি রাইফেল বা সোয়াগার স্টিক—
দুই ক্ষেত্রেই সাম্প্রতিক সফরে পাকিস্তানি জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার আচরণ ও প্রতীকী ইঙ্গিত নিয়ে আলোচনা চলছে।
এর আগে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও তিনি কাঁধে ব্যাটন নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, যা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত হিসেবে সমালোচিত হয়।
এবার লাগেজে ডামি রাইফেল— এটি নিছক প্রতীক নাকি কোনো বার্তা— তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিশ্লেষক মহলে।
কারণ, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির একজন প্রতিনিধি হিসেবে এক পাকিস্তানি জেনারেলের হাতে এমন “অস্ত্রসদৃশ উপহার” প্রতীকী দিক থেকেও সংবেদনশীল।
একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মন্তব্য করেন,
“এটা হয়তো কূটনৈতিক অসতর্কতা, কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা নিছক বিষয় নয়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাকিস্তানের ভূমিকা বিবেচনায় এ ধরনের প্রতীকও জনগণের মনে অস্বস্তি তৈরি করে।”
উপসংহার
সিআইপি গেটে কয়েক মিনিটের নিরাপত্তা তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত ‘বড় কোনো বিপত্তি ঘটেনি’, তবে ঘটনাটি উভয় দেশের প্রটোকল সংস্থাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সতর্কতাই যে এমন একটি সংবেদনশীল পরিস্থিতিকে বড় কূটনৈতিক জটিলতায় রূপ নিতে দেয়নি—তা বলাই যায়।
এই ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিল—
রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ও নিরাপত্তা বিধি কোনো ‘সৌজন্যতার চাপে’ শিথিল করা যায় না।
কারণ, প্রতিটি সামান্য অসতর্কতা বড় কূটনৈতিক বার্তায় পরিণত হতে পারে।
