জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পরিকল্পনাকে ঘিরে বিতর্ক তীব্র হয়েছে। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেছেন, ‘ছিল ঘোড়ার ডিম, এখন ফুটে খচ্চর বের হয়েছে।’ সংস্কার প্রক্রিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ব্যর্থতার ইঙ্গিত কী?
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রকাশিত চূড়ান্ত সংস্কার রিপোর্ট এখন দেশজুড়ে তর্কের কেন্দ্রবিন্দু। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল তাঁর সাম্প্রতিক ভিডিও বার্তায় তীব্র ব্যঙ্গ করে বলেছেন, “ছিল ঘোড়ার ডিম, এখন ওখান থেকে বের হয়েছে খচ্চরের বাচ্চা।” এই রূপক ব্যবহারের মধ্যে নিহিত আছে এক গভীর হতাশা ও রাজনৈতিক সংশয়ের প্রতিফলন।
তাঁর মতে, ‘সংস্কার’ নামে যে প্রক্রিয়াটি ঘোষিত হয়েছিল, তা এখন এক ধরনের অদ্ভুত প্রশাসনিক পরীক্ষাগার, যেখানে রাজনৈতিক বাস্তবতা ও জনসমর্থনের কোনো স্থান নেই।
ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, সরকার (অর্থাৎ ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন প্রশাসন) ‘জুলাই জাতীয় সনদ সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫’ জারি করবে।
এরপর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে সেটি অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর হবে।
এই পরিকল্পনা অনুসারে, পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নতুন নাম হবে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’, যাদের প্রধান কাজ হবে জুলাই সনদের ধারাগুলো বাস্তবায়ন করা।
কিন্তু তাঁদের নিজস্ব কোনো আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের ক্ষমতা থাকবে না।
এখানেই মূল প্রশ্ন:
জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি একটি কমিশনের তৈরি খসড়া অনুযায়ী পরিচালিত হন, তাহলে গণতন্ত্রের মূল অধিকার—বিধান প্রণয়নের স্বাধীনতা—কোথায় থাকবে?
“এরা নির্বাচনে দাঁড়াক, জামানত রাখতে পারবে?”
মাসুদ কামাল তাঁর মন্তব্যে আরও বলেছেন,
“বদিউল আলম মজুমদার, ড. আলী রীয়াজ, মনির হায়দার—এরা জনগণের ভোটে দাঁড়াক, যদি জামানত রাখতে পারে, তাহলে আমাকে বইলেন।”
এই বক্তব্য শুধু ব্যঙ্গ নয়; এটি আসলে বর্তমান সিভিল-সোসাইটি নির্ভর রাজনীতিকরণের মডেল-এর উপর আস্থা হারানোর ইঙ্গিত।
তিনি প্রশ্ন তুলেছেন—যাঁরা জনগণের ভোটে কখনো নির্বাচিত হননি, তাঁরা কীভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর নীতিগত কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে পারেন?
কমিশনের প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী, নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ২৭০ দিনের মধ্যে নির্ধারিত নীতিমালা বাস্তবায়ন করবেন।
অর্থাৎ, তাঁরা কার্যত নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হবেন।
এই মডেল কিছু বিশ্লেষকের মতে, “সংবিধান সংস্কারের নামে নতুন এক ধরনের কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ববাদ” প্রতিষ্ঠার ঝুঁকি তৈরি করছে।
যেখানে জনগণ শুধু ভোটার, কিন্তু নীতিনির্ধারক নয়—সেখানে গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
এখন প্রশ্ন একটাই—এই “সংস্কার প্রক্রিয়া” আসলে রাষ্ট্র মেরামতের উদ্যোগ, নাকি রাজনৈতিক পুনর্গঠনের গোপন রূপরেখা?
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো, কমিশনের উপদেষ্টা গোষ্ঠী, এবং জুলাই সনদের আদেশ—
সব মিলিয়ে এটি এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নতুন বিন্যাসের পরীক্ষাগার হিসেবে পরিণত হচ্ছে।
মাসুদ কামালের “ঘোড়ার ডিম” থেকে “খচ্চর” উপমা শুধু ব্যঙ্গ নয়; এটি আসলে এক প্রতীকী সতর্কবার্তা—
একটি জনগণবিহীন সংস্কার প্রক্রিয়া কখনো পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র উৎপাদন করতে পারে না।
বরং তা হয়তো এমন এক সংবিধান জন্ম দেবে, যার ভেতর থাকবে অর্ধেক ঘোড়া আর অর্ধেক গাধার বৈশিষ্ট্য—
দৌড়াতে পারে না, বোঝা বইতে বাধ্য।
