শেকৃবিতে ছাত্রদল নেত্রী তাহসিন আক্তার মুন কর্তৃক দুই ছাত্রীকে প্রোগ্রামে না যাওয়ায় রুম ছাড়ার হুমকি, যা নতুন ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও আধিপত্যবাদী রীতিনীতিতে আবদ্ধ। তবে এবার বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে এক নতুন নাম—ছাত্রদল নেত্রী তাহসিন আক্তার মুন। অভিযোগ উঠেছে, তিনি দলীয় প্রোগ্রামে অংশ না নেওয়ায় দুই ছাত্রীকে রুম ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন। বিষয়টি শুধু একটি ‘ব্যক্তিগত আচরণ’ নয়, বরং এটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন—যেখানে গণতন্ত্রের নামে গোষ্ঠীগত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে।
ছাত্রী রূপা রহমান ও উম্মে সুমাইয়া সুপ্তির বক্তব্য অনুযায়ী, তাদেরকে পরীক্ষার আগের রাতেও প্রোগ্রামে যেতে বাধ্য করার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে, “ক্লাসে যেও না, স্যার প্রেজেন্ট দিয়ে দেবে।”
এখানেই প্রশ্ন জাগে—একজন দলীয় নেত্রীর পক্ষে কি এমন দাবি করা সম্ভব, নাকি এর পেছনে আরও শক্ত কোনো নেটওয়ার্ক সক্রিয়?
এই ঘটনা আরও একটি গভীর সংকেত দেয়—ছাত্ররাজনীতির রুটিন অমান্য করে রীতিমতো ‘গণরুম-পলিটিক্স’ চালু রাখা হচ্ছে। যে কক্ষে থাকা হবে, তা দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হচ্ছে—এ এক ধরনের ‘অদৃশ্য শাসন’ ব্যবস্থা।
এক সময় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ শোনা যেত। কিন্তু এবার সেই চিত্রের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে বিরোধীদল ছাত্রদলের মধ্যেও।
সুপ্তির বক্তব্য, “মনে হচ্ছে ছাত্রলীগের আগের যুগ ফিরে এসেছে। তারা ক্ষমতায় না থেকেও যা করছে, ক্ষমতায় এলে কী করবে?” — এ বক্তব্য শুধুই আতঙ্ক নয়, বরং ভবিষ্যতের একটি রাজনৈতিক হুমকির পূর্বাভাস।
এই প্রতিযোগিতামূলক দখলদারি সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের স্বাধীন মত প্রকাশ, লেখাপড়া ও আবাসন নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
তাহসিন আক্তার মুন শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে, রুম ছাড়ার কথা বলা ভুল ছিল। তবে তার যুক্তি ছিল, ওই রুম বরাদ্দ ছিল ফ্যাকাল্টির সেরা শিক্ষার্থীদের জন্য।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—তিনি কিভাবে প্রভোস্টের অনুমতি ছাড়াই এই ‘বরাদ্দ নীতিমালা’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন?
এদিকে ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বিষয়টিকে ‘ব্যক্তিগত’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এতে প্রমাণ হয়, দলীয় কাঠামোর ভেতরেই দায়বদ্ধতার অভাব রয়েছে। যখন কোনো নেত্রী নিজ ক্ষমতাবলে ছাত্রলীগ কর্মীদের হল থেকে তাড়ানোর হুমকি দেন, তখন সেটি ‘ব্যক্তিগত’ নয়—এটি রাজনৈতিক দলীয় আচরণের প্রতিফলন।
হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়া এবং গণআলোচনার পরও প্রশাসন এখনো পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি। এই নিষ্ক্রিয়তা রাজনৈতিক দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক দুর্বলতা ও পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবেরই প্রতিচ্ছবি।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনাটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ইস্যু নয়। এটি আমাদের সামনে আবারও সেই পুরনো প্রশ্নটি তুলে ধরছে—
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি শিক্ষার জন্য, নাকি রাজনীতির অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে?
ছাত্র রাজনীতি প্রয়োজন, কিন্তু তা হতে হবে নেতৃত্ব তৈরির মাঠ, জবরদস্তি ও আধিপত্যের ক্ষেত্র নয়।
তাই এখন সময় এসেছে—বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়ার—শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক চাপ আর নয়।
