চ্যাথাম হাউসে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নয়, বরং নিরাপত্তার স্বার্থে কার্যক্রম স্থগিত। অন্তর্বর্তী সরকারের এই অবস্থান কতটা গ্রহণযোগ্য, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই কলামে।

বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান অস্থির প্রেক্ষাপটে চ্যাথাম হাউসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য শুধু একাডেমিক আলোচনার বিষয় নয়, বরং তা একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসন ব্যবস্থার বাস্তবচিত্রকে প্রকাশ করে। আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং “কার্যক্রম স্থগিত”—এই ব্যাখ্যার পেছনে কী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে, তা বিশ্লেষণ করাই এ লেখার উদ্দেশ্য।
১১ জুন লন্ডনের চ্যাথাম হাউসে আয়োজিত আলোচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষা ব্যবহার করলেও এক পর্যায়ে স্পষ্ট করেন যে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। বরং দেশের “রাজনৈতিক নিরাপত্তা” রক্ষার স্বার্থে তাদের কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। এই ব্যাখ্যা, যদিও আইনি-প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণে কৌশলী, তবুও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা অনেক বড় বার্তা দেয়।
যখন চ্যাথাম হাউসের পরিচালক ব্রনওয়ে ম্যাডক্স তাঁকে প্রশ্ন করেন যে বিরোধীদের বাইরে রেখে কীভাবে একটি “জাতীয় ঐকমত্য” তৈরি করা হচ্ছে, তখন ড. ইউনূস পাল্টা প্রশ্ন তোলেন—আওয়ামী লীগ আদৌ রাজনৈতিক দল কি না, যদি তারা হত্যাকাণ্ড, গুম, দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে।
এই বক্তব্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগকে এক ধরনের অপরাধী গোষ্ঠী হিসেবে চিত্রিত করার অপপ্রচেষ্টা স্পষ্ট
আইনগতভাবে নিষিদ্ধ না হলেও কার্যক্রম স্থগিত করা হলে তা রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিষেধাজ্ঞার সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যদি স্থগিতাদেশ অনির্দিষ্টকালীন হয় এবং তার সঙ্গে বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা যুক্ত হয়, তবে সেটি কার্যত দলটিকে রাজনীতির মাঠ থেকে মুছে দেওয়ার সমতুল্য হয়ে ওঠে।
ড. ইউনূসের ভাষায়, “বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে”—এই বাক্য থেকেই বোঝা যায়, এটি খোলাখুলি নিষেধাজ্ঞা না হলেও রাজনৈতিকভাবে তা একই ফলাফল দিচ্ছে।
সঞ্চালক যখন জানতে চান, বিচার কাজ কেন একটি নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না, তখন ড. ইউনূস বলেন, “আমি এই সিদ্ধান্ত নিইনি, আমাদের আমন্ত্রণকারীরাই দায়িত্ব দিয়েছে।”
এই বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের গণতান্ত্রিক স্বীকৃতি ও জবাবদিহিতার অভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারা এই ‘আমন্ত্রণকারী’? তারা কি জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো সংস্থা? না কি সেনা ও বিউরোক্র্যাটিক কাঠামোর অন্ধকার কোন স্তরের নির্দেশ? প্রশ্ন থেকেই যায়।
ড. ইউনূস ঘোষণা দেন যে আগামী নির্বাচন হবে “নতুন বাংলাদেশের জন্য ভোট।” এটি হবে “১৭ বছর পর একটি সত্যিকারের নির্বাচন।”
কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো—যদি সবচেয়ে বড় বিরোধীদল মাঠে না থাকে, সংবাদমাধ্যম হুমকির মুখে থাকে, এবং অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক বৈধতার প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ হয়—তাহলে এই নির্বাচন কীভাবে “সত্যিকারের” হতে পারে?
সংবাদমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়নের প্রশ্নে ড. ইউনূসের বক্তব্য—“তাদের জীবনে এত স্বাধীনতা কখনো ছিল না”—আশ্চর্যের এবং বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গত ১০ মাসে বহু সাংবাদিক আটক হয়েছেন, মিডিয়া হাউস বন্ধ হয়েছে, অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করা হয়েছে। এটি কি স্বাধীনতা?
ড. ইউনূসের বক্তৃতা একদিকে যেমন রাজনৈতিক কৌশলে পূর্ণ, তেমনি এক ধরনের দার্শনিক আত্মপক্ষ সমর্থনেরও প্রতিফলন। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করে কার্যক্রম ‘স্থগিত’ ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—বাংলাদেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে মাঠছাড়া করে কোনো “নতুন বাংলাদেশ” তৈরি সম্ভব নয়।
