ঝিনাইদহে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বেড়েছে সহিংসতা ও প্রাণহানি। দলীয় দ্বন্দ্বে তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে বিএনপি। বিশ্লেষণ জানুন এই প্রতিবেদনে।
দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিপক্বতা অর্জনের কথা বললেও, বাস্তবে নিজেদের ভেতরের কোন্দলেই এখন আত্মবিধ্বংসী পথে হাঁটছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ঝিনাইদহ জেলা এখন এর এক ভয়াবহ উদাহরণ। মনোনয়ন যুদ্ধ ও ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা পরস্পর বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়েছেন, যার ফলাফল—রক্তপাত, মৃত্যু, হামলা, মামলা, আতঙ্ক এবং সাংগঠনিক ভাঙন।
গত দুই মাসে ঝিনাইদহের বিভিন্ন উপজেলায় বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত পাঁচজন। আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। সদরের দীঘিরপাড়, কালীগঞ্জের নাকোবাড়িয়া, শৈলকুপার রামচন্দ্রপুর, কবিরপুর, ও ভাটইবাজার—প্রতিটি ঘটনায় জড়িত রয়েছে দলের নিজস্ব গ্রুপ।
- ৩০ এপ্রিল, দীঘিরপাড়ে সংঘর্ষে নিহত হন কৃষক জাহাঙ্গীর হোসেন ও ছাত্র নাহিদ।
- ১ জুন, নাকোবাড়িয়ায় ভাইয়ে ভাইয়ের মৃত্যু—ইউনুস আলী ও মহব্বত আলী।
- ১৩ জুন, ককটেল ছোড়া হয় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা জয়ন্ত কুমার কুন্ডুর ওপর।
- ১৫ ও ১৬ জুন, শৈলকুপার বিভিন্ন এলাকায় হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, বাড়িঘর ভাঙচুর এবং অন্তত ১২ জন আহত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঝিনাইদহ-১ এবং ঝিনাইদহ-৪৯ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এসব ঘটনার মূল কারণ। দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়াই নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে মিছিল, সভা ও এমনকি হামলা পর্যন্ত পরিচালনা করছেন।
আশঙ্কাজনকভাবে এসব সংঘর্ষে দলের সাধারণ কর্মী ও সাধারণ জনগণও ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
কালীগঞ্জে সংঘর্ষের জেরে উপজেলা কমিটি বিলুপ্ত করে দুই নেতাকে বহিষ্কার করলেও, অন্যান্য উপজেলার ক্ষেত্রে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার বার্তা দিলেও, বাস্তবে তৃণমূল পর্যায়ে তা প্রয়োগ হয়নি বললেই চলে।
সুজনের জেলা সভাপতি আমিনুর রহমান সঠিকভাবে উল্লেখ করেছেন, “দীর্ঘ ১৭ বছরের আন্দোলনের অর্জন আজ নিজেদের দ্বন্দ্বেই ভেঙে পড়ছে।” অন্যদিকে জেলা বিএনপি সভাপতি অ্যাডভোকেট এম এ মজিদ দাবি করছেন, “সংঘর্ষকারীদের সতর্ক করা হয়েছে” — যদিও বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
এই রাজনৈতিক সহিংসতা সাধারণ জনগণের মাঝেও ভয়ানক প্রভাব ফেলছে। একদিকে তারা আতঙ্কে বাস করছেন, অন্যদিকে বিএনপির ওপর রাজনৈতিক আস্থাও হারাচ্ছেন। নির্বাচনের মুখে এ ধরনের নেতিবাচক চিত্র দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। ফলে ভোটের রাজনীতিতে দলটি আরও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
- এখনই সাংগঠনিক কাঠামো ঢেলে সাজানো না হলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনেও এই কোন্দলের কারণে বিএনপি বড় ক্ষতির মুখে পড়বে।
- জেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে দলীয় শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে বিশেষ টাস্কফোর্স বা তদারকি কমিটি প্রয়োজন।
- মনোনয়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী না হলে কোন্দল প্রশমিত হবে না।
ঝিনাইদহে বিএনপির কোন্দল এখন শুধু দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়—এটি স্থানীয় জনজীবন ও জাতীয় রাজনীতির জন্য এক উদ্বেগজনক হুমকি। যারা জাতীয়তাবাদের পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে, তারাই এখন গণমুখী রাজনীতির আদর্শ বিসর্জন দিয়ে স্বার্থপর সংঘর্ষে লিপ্ত। এই কোন্দল যদি এখনই রোধ না করা যায়, তাহলে শুধু ঝিনাইদহ নয়, সারাদেশেই এর নেতিবাচক প্রতিধ্বনি শোনা যাবে।
