 
                  ঢাকা বিমানবন্দরে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার কেবিনট্রলি থেকে গুলিভর্তি ম্যাগাজিন উদ্ধারের ঘটনায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্কৃতি নিয়ে গভীর প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষণ পড়ুন।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একজন শীর্ষ সরকারি উপদেষ্টার কেবিনট্রলি থেকে গুলিভর্তি অস্ত্রের ম্যাগাজিন উদ্ধারের ঘটনা নিঃসন্দেহে দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। আজ ২৯ জুন রবিবার সকাল ৭:০৮ মিনিটে মরক্কোগামী টার্কিশ এয়ারলাইন্সের TK-713 ফ্লাইটে উঠার সময় যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া-র কেবিন লাগেজ স্ক্যানিংয়ে এই বিপজ্জনক সামগ্রী শনাক্ত করেন বিমানবন্দরের এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক) সদস্যরা।
উপদেষ্টা যাচ্ছিলেন মরক্কোর মারাকেশে ওআইসি যুব আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য সরকারি সফরে। অথচ ঠিক এই সফরের প্রাকমুহূর্তেই তার লাগেজ থেকে প্রচলিত আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারযোগ্য ম্যাগাজিন বের হওয়া নিছক অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি না, না কি এর পেছনে গভীর নিরাপত্তাজনিত গাফিলতি বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে—এই প্রশ্ন এখন সর্বত্র।উপদেষ্টা নিজে বলেছেন, “তাড়াহুড়ায় ভুলবশত ম্যাগাজিনটি রেখে গিয়েছিলাম।” যদি তা-ই হয়, তাহলে মন্ত্রিপরিষদের একজন সদস্যের বিমানযাত্রার আগে কোনো পর্যায়ে চূড়ান্ত চেকলিস্ট প্রয়োগ হয়নি কেন?
আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো, ম্যাগাজিন উদ্ধারের পর একজন সচিব উপস্থিত হয়ে পুরো পরিস্থিতি “নিয়ন্ত্রণে” নেন, নিজের হেফাজতে ম্যাগাজিন নিয়ে নেন এবং পরে উপদেষ্টাকে গ্রিন চ্যানেল ব্যবহার করে বিমানে ওঠার পূর্ণ সুবিধা দেন।
এ ঘটনায় দুটি দিক অত্যন্ত গুরুতর—
- প্রথমত, এমন কোনো সামগ্রী বিমানে বহন করা হলে তা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিমান নিরাপত্তার চরম লঙ্ঘন।
- দ্বিতীয়ত, ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার বা “তড়িৎ সমাধান”-এর সংস্কৃতি আমাদের প্রশাসনিক স্বচ্ছতায় গভীর আস্থার সঙ্কট তৈরি করে।
এর আগেও শোনা গিয়েছিল যে, আসিফ মাহমুদ একবার অস্ত্রসহ হেলিকপ্টারে উঠতে গিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন, যা পরবর্তীতে সরকার নীরবে সমাধান করে। পুনরায় একই ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে যে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন নিয়ে আসিফ মাহমুদের এক বক্তব্যের উদ্ধৃতি ঘুরছে, যেখানে তিনি বলেছেন, “ছাত্ররা সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।”
যদি শীর্ষ পর্যায়ের ছাত্রনেতৃত্ব ও উপদেষ্টার মধ্যে এমন মনোভাব প্রচলিত হয়, তাহলে অস্ত্র বহন এবং গুলি-বারুদের প্রসঙ্গ আর ততোটা “ভুলবশত” থেকে যায় না।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন—
- একজন যুব উপদেষ্টার ব্যক্তিগত অস্ত্র কেন থাকতে হবে?
- কেন এর গুলিভর্তি ম্যাগাজিন সরকারি সফরের লাগেজে থেকে যাবে?
- রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কেন এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রকাশ করছে না?
বিমানবন্দরের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়া হয়নি। এমনকি সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষও নিশ্চুপ। অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, এই ধরনের নিরাপত্তা লঙ্ঘন হলে ফ্লাইটে ওঠা সাময়িক স্থগিত করে বিস্তারিত অনুসন্ধান করা বাধ্যতামূলক।এখন প্রশ্ন উঠছে—
“নিরাপত্তার নামে সর্বত্র যে কঠোর প্রোটোকল আরোপ করা হয়, তা কি শুধুমাত্র সাধারণ যাত্রীর জন্য?”
যখন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ধরা পড়ে, তখন তার লাগেজ থেকে গুলি বেরিয়ে আসলেও যেন ‘সব ঠিক আছে’ ঘোষিত হয়।
একজন মন্ত্রীপর্যায়ের উপদেষ্টার লাগেজ থেকে ম্যাগাজিন উদ্ধার দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতে সরাসরি আঘাত।
ওআইসি যুব প্রোগ্রামে যোগদানের আগেই এমন ঘটনা আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরাপত্তা সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
যদি সরকার বা প্রশাসন সত্যিই বিশ্বাস করে যে এটি নিছক দুর্ঘটনা, তাহলে এর পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ। অন্যথায় এই ঘটনাও আগের ঘটনার মতো ধামাচাপা পড়ে যাবে।
আজকের এই প্রবন্ধ কোনো চূড়ান্ত রায় নয়। বরং এটাই প্রশ্ন তোলার সময়—
- কারা নিরাপত্তা প্রোটোকলের ঊর্ধ্বে?
- কারা রাষ্ট্রের আইনকে তুচ্ছ করতে পারে?
- এবং এই সংস্কৃতি চলতে থাকলে আমাদের নিরাপত্তার ভবিষ্যত কোথায় দাঁড়াবে?
দেশের মানুষের জানা দরকার, একজন যুব উপদেষ্টা কিসের জন্য অস্ত্র-গুলির প্রয়োজন বোধ করেন। সেই উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত এই ঘটনাকে নিছক ভুল হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

 
                         
         
         
        