 
                  গাজীপুরের গ্রিনল্যান্ড পোশাক কারখানায় ১৯ বছরের শ্রমিক হৃদয়কে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় মালিকপক্ষ, রাষ্ট্র এবং মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে বিশ্লেষণ।
ঈদের আগে নতুন মোটরসাইকেল কেনার স্বপ্ন দেখছিল গাজীপুরের গ্রিনল্যান্ড গার্মেন্টস কারখানার ইলেকট্রিক মেকানিক হৃদয়। উনিশ বছরের সেই ছেলেটি চেয়েছিল মা-বোনকে নিয়ে ঈদের সকালে একটু ঘুরতে যাবে। কিন্তু তার স্বপ্নের আগে সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে দেখে নিয়েছে “গরিব মিস্ত্রি”, “অশিক্ষিত শ্রমিক” কিংবা “নির্দেশনা অমান্যকারী সাহসী ছেলে” হিসেবে।
গত শনিবার সকাল। কারখানায় বিদ্যুৎ সংক্রান্ত একটি সমস্যায় অফিসিয়াল অনুমতি ছাড়াই হৃদয় সেটি মেরামতের চেষ্টা করে। সহকর্মীরা বলে, সে শুধু যা নষ্ট ছিল তা ঠিক করছিল। কিন্তু কারখানার কিছু কর্তৃপক্ষ একে দেখে “আদেশ অমান্য” হিসেবে। তাদের মনে হয়—একজন দরিদ্র শ্রমিক এত বড় সাহস দেখায় কীভাবে?
এরপর অফিসের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। লোহার রড, পাইপ, জুতা, ঘুষি—সব দিয়ে মারা হয় তাকে। একজন সহকর্মী কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বাইরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, “ভাই, বাঁচান, ওরে মারতেছে।” ভেতর থেকে উত্তর আসে, “তোদেরও উচিত শিক্ষা দিতে হবে।”
ঘণ্টাখানেক পর হৃদয়ের নিথর দেহ পড়ে থাকে কারখানার পেছনের ঘরে। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার জানায়— “ডেড অন অ্যারাইভাল।” অর্ধখোলা চোখ, মুঠো করা হাত—যেন কিছু বলতে চেয়েও পারেনি সে।
এরপর শুরু হয় প্রভাবশালী মালিকপক্ষের আরেকটি অপারেশন— “তথ্য দমন।”
পুলিশ আসে, মামলা দায়ের হয়—“অসুস্থ হয়ে মৃত্যু” বলে রিপোর্ট লেখা হয়। মিডিয়ায় প্রচার হয়—“পরিবার শান্ত আছে।”
কিন্তু তখন হৃদয়ের মা হাসপাতালের করিডোরে দৌড়াচ্ছেন পাগলের মতো। চিৎকার করছেন—“আমার ছেলে অসুস্থ ছিল না! ওরে পিটিয়ে মারছে… ওর মুখের ওপর পা দিছে!”
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কিছু শ্রমিক রাস্তায় নামতে চায়। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের পথে দেয় জলকামান, টিয়ার গ্যাস, র্যাব-পুলিশ। বলা হয়—“তথ্য বিভ্রান্তিমূলক”, “গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীলতা” তৈরি করা হচ্ছে।
একটি জাতীয় পত্রিকা শিরোনাম করে—“বেতন না বাড়ানোর ইস্যুতে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে একটি মহল।” হৃদয়ের নাম কোথাও নেই।
এভাবেই চাপা পড়ে যায় এক তরুণের স্বপ্ন, বঞ্চনার প্রতিবাদ।
কবর হয় সন্ধ্যাবেলা, চারজন সহকর্মী কাঁধ দেয়, মালয়েশিয়ায় থাকা বড় ভাই কান্না চেপে রাখে। আর মা শুধু একবার প্রশ্ন করেন— “ওরে মারলো ক্যান গো? উনি কি মানুষ আছিল না?” কেউ জবাব দেয় না।এই জুলাইয়ে ব্যানারে লেখা ছিল— “মজুরের অধিকার, দেশের অগ্রগতি”
কিন্তু হৃদয়ের জন্য এই জুলাই মানে একটি কাফনের মাস।
হৃদয়ের নামের পাশে কোনো দিবস হবে না, কোনো রাষ্ট্রীয় শোক থাকবে না, মিডিয়া ব্যস্ত থাকবে “গুজব প্রতিরোধে”। আর আমাদের বিবেক?
হয়তো তা বিক্রি হয়ে গেছে সেই আগুনপ্রতিরোধী হেলমেটের টেন্ডারে, যেখানে মালিক-প্রশাসন একাকার।
হৃদয়ের গায়ে সার্টিফিকেট ছিল না, গলায় ডিগ্রি ছিল না—কিন্তু ছিল শ্রম, স্বপ্ন ও রক্ত। আর আজ তার পরিচয় কেবল এক কবরের মাটিতে— “হৃদয়, পিতা: আব্দুল মালেক, মৃত্যুঃ ২০২৫, কারণ: পেটানো।”
এই রাষ্ট্র যদি সত্যিই শ্রমিকবান্ধব হয়, তবে হৃদয়ের মতো মৃত্যু আর কখনও যেন না হয়।

 
                         
         
         
        