১৯৪৭ সালে বাংলা ভূখণ্ড পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি ছিল একটি স্থায়ী অভিশাপ যা সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দু’দেশই চাইছিল পাকিস্তানকে একটি সামরিক কৌশলগত ঘাঁটিতে পরিণত করতে, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ঠেকানো যায়।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজন উপমহাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক ভূমিকম্প। স্বাধীনতার উচ্ছ্বাসের আড়ালে ঘটেছিল ক্ষমতার নোংরা খেলা, গোপন সমঝোতা আর কূটনৈতিক প্রতারণা। বাংলা ভূখণ্ড, যার ছিল হাজার বছরের ঐক্য ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি, হঠাৎ করেই পাকিস্তানের আওতায় চলে গেল—যেখানে বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ছিল দ্বিতীয় সারির বিষয়। এই কলামে আমরা উন্মোচন করব সেই নেপথ্য চুক্তি, ব্যক্তিগত স্বার্থ, এবং আন্তর্জাতিক কূটচাল যা বাংলার এই ভাগ্য নির্ধারণ করেছিল। বাংলা ভূখণ্ডের জন্য এই স্বাধীনতার ভোর হয়ে দাঁড়ায় এক অন্ধকার অধ্যায়। ইতিহাস প্রমাণ করেছে—বাংলা জাতির জন্য এই বিভাজন ছিল মুক্তির চেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ।
বঙ্গভঙ্গ প্রথম ঘটে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের হাত ধরে।
তখনকার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক সুবিধা নয়, বরং হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের বীজ বপন করা।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়, এবং ১৯১১ সালে তা প্রত্যাহার করা হয়।
কিন্তু ব্রিটিশরা বুঝে গিয়েছিল—বাংলা ঐক্য যতদিন থাকবে, উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ততই শক্তিশালী হবে।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব ছিল পাকিস্তানের ধারণাগত জন্ম।
যদিও এই প্রস্তাবে ‘পূর্ব বাংলা’ বা ‘বাংলার বিভাজন’ স্পষ্ট করে উল্লেখ ছিল না, মুসলিম লীগের নেতৃত্ব জানত—মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো আলাদা করলেই পাকিস্তান বাস্তবায়ন সহজ হবে।
১৯৪৭ সালের বিভাজনে বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত এলো মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে, যেখানে প্রকৃত বাঙালির মতামতকে উপেক্ষা করা হয়।
ব্রিটিশ নীতি ছিল “Divide and Rule”, আর এই নীতি কার্যকর করতে বাংলা ছিল সবচেয়ে বড় বলির পাঁঠা।
পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃত্ব—শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন—প্রথমে ভিন্ন মত পোষণ করলেও ক্রমে কেন্দ্রীয় লীগের চাপে পাকিস্তান প্রস্তাবে সায় দেন।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় ব্যাপক বিজয় লাভ করে, যা পাকিস্তান প্রস্তাবকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়।
১৯৪৭ সালের প্রথমার্ধে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কংগ্রেস নেতা সারদার বল্লভভাই প্যাটেল-এর মধ্যে গোপন বৈঠকে একটি পরিকল্পনা ওঠে—বাংলা যেন না যায় পাকিস্তান বা ভারতের অধীনে, বরং আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়—United Bengal।
এই প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভাই শরৎ বসু।
কিন্তু কংগ্রেস উচ্চ নেতৃত্ব (গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল) দ্রুত বুঝে যায়, United Bengal হলে ভারত ভৌগোলিকভাবে দুর্বল হবে।
হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি তীব্রভাবে বিরোধিতা করেন, দাবি করেন—“বাংলা যদি স্বাধীন হয়, তবে হিন্দুরা চিরকাল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের অধীনে থাকবে।”
ফলে United Bengal প্রস্তাব ভেস্তে যায়, আর পাকিস্তানপন্থীরা শক্ত অবস্থান নেয়।
ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি বুঝে গিয়েছিলেন—বাংলা যদি পাকিস্তানে যায়, তাহলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্থায়ী বিরোধ থাকবে, যা ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটিশ ও পশ্চিমা প্রভাব বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
র্যাডক্লিফ কমিশন-এর মাধ্যমে সীমানা এমনভাবে টানা হয় যাতে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র কলকাতা ভারতের অধীনে থাকে।
কিন্তু কৃষি ও কাঁচামালের ভান্ডার পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অধীনে পড়ে।
এতে ভারত ও পাকিস্তান দু’দেশই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে—যা ছিল ব্রিটিশ কৌশলের মূল উদ্দেশ্য।
পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য পাঞ্জাব ও বাংলার মুসলিম নেতৃত্বকে একমত করতে জিন্নাহ ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতি দেন যে, পূর্ববাংলা হবে পাকিস্তানের “সাংস্কৃতিক হৃদয়” এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রাধিকার পাবে।
বাস্তবে এই প্রতিশ্রুতি ছিল মিথ্যা।
করাচি ও রাওয়ালপিন্ডির সামরিক-আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠী পূর্ববাংলাকে কাঁচামালের উপনিবেশে পরিণত করার পরিকল্পনা করে রেখেছিল।
১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে করাচিতে অনুষ্ঠিত এক গোপন বৈঠকে (যেখানে ছিলেন জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমুদ্দিন, সোহরাওয়ার্দী) ঠিক হয়—বাংলার পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য গণভোটের পরিবর্তে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।
মুসলিম লীগের প্রচারণা ছিল—পাকিস্তান হবে মুসলমানদের জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র, যেখানে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হবে এবং কৃষকরা জমির মালিক হবে।
গ্রামীণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে এই প্রতিশ্রুতি ছিল স্বপ্নের মতো, যা তাদের পাকিস্তান প্রস্তাব সমর্থনে উদ্বুদ্ধ করে।
কিন্তু বিভাজনের পরও জমিদারি প্রথা অব্যাহত থাকে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বেড়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, দু’দেশই চাইছিল পাকিস্তানকে একটি সামরিক কৌশলগত ঘাঁটিতে পরিণত করতে, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ঠেকানো যায়।
বঙ্গোপসাগর নিয়ন্ত্রণের জন্য পূর্ববাংলা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া পশ্চিমা শক্তির কাছে ছিল লাভজনক।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নয়—এটি ছিল এক সুপরিকল্পিত অভিশাপ, যার লক্ষ্য ছিল বাংলা ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক শক্তিকে চূর্ণ করা।
ইতিহাস প্রমাণ করেছে, ব্রিটিশের আঁকা সীমারেখা শুধু মানচিত্রে নয়—এটি মানুষের হৃদয়ে গভীর ক্ষত এঁকে দিয়েছে।
সেই ক্ষত আজও রক্তক্ষরণ করছে।
এটি ছিল উপনিবেশের নতুন পোশাক, যেখানে ব্রিটিশ-মার্কিন দের আজিবনের জন্য জায়গা নিল পাকিস্তানি সামরিক-আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠী।
ইতিহাস সাক্ষী—এই অভিশাপের অবসান ঘটাতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অবশ্যম্ভাবী।
কিন্তু ৭১ এর পরাজিত শক্তি এবং উপনিবেশের পোশাক ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তিত হয়ে ফিরে আসে বাংলা নামক একটি অভিশপ্ত ভূখণ্ডে।
