ফেনীতে ছাত্রলীগ নেতা ছেলের গ্রেফতার দেখেই হৃদরোগে বাবার মৃত্যু—এই ঘটনায় উঠে এসেছে আইনি স্বচ্ছতা, পুলিশের হয়রানি ও রাজনৈতিক পরিচয়ের দ্বৈত ব্যবহার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বিস্তারিত বিশ্লেষণ পড়ুন।

ফেনীর শর্শদীতে যা ঘটেছে, তা কেবল এক পরিবারের হৃদয়বিদারক ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়—এটি আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিচারহীনতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আইন প্রয়োগে দ্বৈত নীতির প্রতিচ্ছবি।
বুধবার (২ জুলাই) সন্ধ্যায় গোয়েন্দা পুলিশ ফেনী সদর উপজেলার শর্শদী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আলী হোসেন ফাহাদকে গ্রেফতার করে। আর রাতেই থানায় ছেলের হাতে হাতকড়া দেখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার বাবা আলী আকবরের।
এই ঘটনায় যেটি নিছক এক পরিবারের শোক বলে পাশ কাটানো যায় না, সেটি হলো—ছেলেকে কোনো মামলা ছাড়াই গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পরিবারের দাবি। এমনকি পুলিশপক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে অভিযোগের ধরন, অভিযোগকারী কিংবা মামলা নম্বর উল্লেখ করা হয়নি।
২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক তরঙ্গ ইতিমধ্যে স্পষ্ট। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, বিএনপি, শ্রমিক দল এমনকি স্থানীয় সন্ত্রাসী চক্রগুলোও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের একজন নেতার গ্রেফতার, আবার কোনো স্পষ্ট মামলার ভিত্তি ছাড়াই—নির্বাচনী দমন-পীড়নের নতুন ধরণ হিসেবেই দেখা যেতে পারে।
আলী আকবর নিজে ছিলেন সদর উপজেলা শ্রমিকদলের সহ-সভাপতি। অর্থাৎ পিতা বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, আর পুত্র ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নেতা। এখানেই তৈরি হয় দ্বৈত দ্বন্দ্ব—এটি কি শুধুই পারিবারিক ট্র্যাজেডি, নাকি লক্ষ্যভেদে ব্যবহৃত রাজনৈতিক কৌশল?
গোয়েন্দা পুলিশের দাবি, তারা মডেল থানার অনুরোধে ফাহাদকে সহায়তা করেছে গ্রেফতারে। কিন্তু থানার ওসি সামসুজ্জামানও কোনো মামলা বা অভিযোগের তথ্য জনসম্মুখে দেননি। বরং বাবার মৃত্যুর পর তাকে আত্মীয়দের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়—যা আরও প্রশ্ন তোলে:
- যদি সে অপরাধী হয়, তবে জামিন কেন?
- যদি সে নির্দোষ হয়, তবে গ্রেফতার কেন?
এই ঘটনাটি পুলিশের একটি চিরাচরিত প্যাটার্নের দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে “অভিযোগ” নামের ধোঁয়াশা ব্যবহার করে বেছে বেছে কাউকে আটক রাখা হয়।
একজন পিতা, যিনি রাজনৈতিকভাবে সচেতন, সন্তানকে হাতকড়া পরা অবস্থায় দেখে হৃদয়ের অতল স্তর থেকে আঘাতপ্রাপ্ত হন। এমন ঘটনা যে কাউকেই ভেঙে দিতে পারে। প্রশ্ন একটাই—এমন মৃত্যু কী কেবল প্রাকৃতিক? নাকি একটি রাষ্ট্রীয় নির্মমতার অপ্রত্যক্ষ ফলাফল?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই লিখছেন, এটি রাষ্ট্রের হাতে এক ধরনের “emotional manslaughter”। কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করত, তাহলে হয়তো এই মৃত্যু এড়ানো যেত।
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জরুরি না শুধু ফেনীর জন্য, বরং গোটা দেশের জন্য—যেখানে গ্রেফতার মানে অনেক সময়ই হয়রানি, আর বিচার মানেই দীর্ঘশ্বাস। আলী আকবরের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—বিচারহীনতার সংস্কৃতি কেবল অন্যায়কে প্রশ্রয়ই দেয় না, প্রকারান্তরে মৃত্যুও ডেকে আনে।
