২০২৪ সালের জুলাই মাসে, ঢাকা মেট্রো স্টেশন, এক্সপ্রেসওয়ে এবং সরকারি ভবনগুলিকে লক্ষ্য করে সমন্বিত সহিংসতার এক ঢেউ প্রত্যক্ষ করে। কয়েক মাস পরে, একজন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারী স্বীকার করেন যে এই আক্রমণগুলি কর্তৃত্ববাদকে উৎখাতের জন্য একটি কৌশলগত বিদ্রোহের অংশ ছিল।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, ঢাকার জনবহুল মিরপুর, মহাখালী, বনশ্রী কিংবা ঢাকার বাইরের ভৈরব, মাদারীপুর ও ময়মনসিংহ—বাংলাদেশের নানা প্রান্ত একসঙ্গে যেন পরিণত হয় দাউদাউ আগুনের নাট্যমঞ্চে। মেট্রোরেল থেকে শুরু করে এক্সপ্রেসওয়ে, সরকারি ভবন থেকে শুরু করে ফায়ার সার্ভিস—সবখানে যেন ছড়িয়ে পড়ে আগুন, ভাঙচুর আর আতঙ্কের ছায়া।
সরকারি তথ্যমতে, ঐদিন সন্ধ্যায় মিরপুর ১০ ও কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনে চালানো হয় ভাঙচুর।
পরবর্তীতে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
একই সময়ে মিরপুর ৬ নম্বরে ইনডোর স্টেডিয়ামে আগুন দেওয়া হয়।
মহাখালীর উড়ালসড়কের টোল প্লাজা ও গাড়িতে আগুন, ফায়ার সার্ভিসের চারটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, পিবিআই কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ইপিআই ভবনে হামলা—সব মিলে এটি ছিল একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সমন্বিত হামলা।
শুধু ঢাকা নয়, কিশোরগঞ্জের ভৈরব বাসস্ট্যান্ড, কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেন, ময়মনসিংহের পুলিশ বক্স, মাদারীপুরের মস্তফাপুর ট্রাফিক পুলিশ বুথ—এমন অনেক স্থানেও চালানো হয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। এ নাশকতার মাত্রা এবং বিস্তার দেখে দেশজুড়ে আতঙ্কের সঞ্চার হয়।
সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে—এটি কি ছিল শুধুই ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ? নাকি পূর্বপরিকল্পিত সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন?
এই ঘটনার তিন মাস পর, ২৬ অক্টোবর ২০২৪, বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসির ‘প্রযত্নে বাংলাদেশ’ টকশোতে এক বিস্ফোরক স্বীকারোক্তি দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম মুখ হাসিবুল ইসলাম।
তিনি বলেন:
“যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না।”
এই বক্তব্য আন্দোলন-সংশ্লিষ্ট অনেকেই দেখেছেন ‘রাজনৈতিক বাস্তবতার ভাষ্য’ হিসেবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি আসলে ছিল একটি স্পষ্ট স্বীকারোক্তি—যা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর ওপর হামলার দায় স্বীকারের সামিল।
এই ঘটনায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় তীব্র বিতর্ক।
একপক্ষ মনে করে, রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তখনই কার্যকর, যখন তা চোখে পড়ার মতো হয়—যেমনটি জুলাইয়ে হয়েছিল।
অন্যপক্ষ মনে করে, মেট্রোরেল বা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে আগুন দেওয়া আসলে জনগণের সম্পত্তি ধ্বংস করা এবং তা কোনোভাবেই নৈতিক আন্দোলন হতে পারে না।
বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, এই হামলা গণআন্দোলনের ‘মোড়কে চালানো গণ-নাশকতা’, যার উদ্দেশ্য ছিল জনমনে ভীতি তৈরি করে সরকারের পতনের পূর্বশর্ত তৈরি করা।
এই নাশকতার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ধরপাকড় চালায়। অনেকে গ্রেফতার হন, কিছু সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, এবং ছাত্র রাজনীতির ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। তবে আন্দোলনের পেছনে থাকা গোপন নেতৃত্ব ও অর্থায়ন কাঠামো এখনো পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।
জুলাই ২০২৪ আমাদেরকে একটি অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়
—নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমরা কি নিজেরাই সহিংসতার অস্ত্র তুলে নিচ্ছি? যদি আন্দোলন জনগণের সম্পদ ধ্বংস করে, তাহলে সে আন্দোলন আর জনগণের হয়ে কথা বলে না।
সমন্বয়ক হাসিবুলের ভাষ্য হয়তো একটি বাস্তব উপলব্ধি—কিন্তু তা ন্যায়সঙ্গত না।
কারণ, বিপ্লব রক্ত চাইতেই পারে, কিন্তু ইতিহাস ক্ষমা করে না যখন সেই রক্তে পুড়ে ছাই হয় স্কুলগামী শিশুর ট্রেন, সরকারি হাসপাতালের টিকা ভবন, কিংবা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীর জীবন।
তথ্যসূত্র:
- প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০২৪
- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৭ অক্টোবর ২০২৪
