 
                  ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে কুখ্যাত রাজাকারদের সমাবেশ হয়। এতে উত্থাপিত হয় রাষ্ট্রের নাম, পতাকা, ও শহীদ মিনার পরিবর্তনের প্রস্তাব।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল মুক্তির ভাষণের ঐতিহাসিক মঞ্চ। আর মাত্র পাঁচ বছরের মাথায়, সেই একই স্থানে ঘটে ইতিহাসের এক করুণ পরিহাস। ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাত মাসের মাথায়, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ মদদে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত হয় এক ভিন্নধর্মী সমাবেশ—যা ছিল স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী চরম মৌলবাদী ও পাকিস্তানপন্থীদের এক মহড়া।
এই সমাবেশের আয়োজন করে ‘সিরাতুন্নবী (সা.) কমিটি’ নামক একটি ধর্মীয় আচ্ছাদনে ঢাকা সংগঠন।
প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিমান বাহিনীর প্রধান ও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল এম.জি. তোয়াব—যিনি জিয়ার সামরিক সরকারের দ্বিতীয় শক্তিমান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
এই অনুষ্ঠানটির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ১৯৭৬ সালের ৮ মার্চের দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায়, যেখানে তোয়াবকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। তার উপস্থিতি এক অর্থে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনের প্রতীক।
সমাবেশে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন যুদ্ধাপরাধে পরবর্তীকালে দণ্ডিত রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। উক্ত প্রস্তাবে তিনটি উল্লেখযোগ্য ও রাষ্ট্রবিরোধী দাবি করা হয়—
- বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ ঘোষণা
- জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তন
- বেদাতি শহীদ মিনার ধ্বংস
অর্থাৎ জাতির অর্জিত ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের ওপর সরাসরি আঘাত হানার পরিকল্পনা গৃহীত হয় এই সভা থেকে।
এখানেই শেষ নয়।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তোয়াব এই সভায় স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন—সরকার এসব দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল। তার বক্তৃতার সময় উঠেছিল স্লোগান:
“তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই, চান-তারা পতাকা চাই!”
এটা শুধু মৌলবাদীদের উন্মাদনা ছিল না, বরং সরকারের সমর্থনে উত্থিত এক বিপজ্জনক রাজনৈতিক প্রকল্প।
১৯৭১ সালের পরপরই গোলাম আযম পাকিস্তান গিয়ে শুরু করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন’।
পরে তিনি সৌদি আরবেও তা চালিয়ে যান।
এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অস্বীকার করে আবার পাকিস্তানের আদলে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র গঠন।
বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চের এই সমাবেশ ছিল সেই আন্দোলনের অংশ এবং জেনারেল জিয়ার সরকার ছিল এর সুবিধাভোগী ও পৃষ্ঠপোষক।
১৯৭৬ সালের এই ঘটনার মাধ্যমে দেখা যায়—যেখানে ১৯৭১ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল বাঙালি জাতিসত্তার মুক্তির প্রতীক, ঠিক সেখানেই ১৯৭৬ সালে একই স্থানকে ব্যবহার করা হয় সেই মুক্তির চেতনা মুছে ফেলার অপচেষ্টায়।
এটি ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় মৌলবাদ ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির পুনর্বাসনের সূচনা।
আর এইসব আয়োজন হয়েছিল এমন এক সময়, যখন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার তো দূরের কথা, ঘাতকচক্রের নেতৃত্বে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছিলেন পুরোপুরিভাবে।
১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি বিভক্তির দিন।
একই দিন, একই স্থান—দুটি ভিন্ন ইতিহাস।
একদিকে ১৯৭১-এর স্বাধীনতার ডাক, আরেকদিকে ১৯৭৬-এর মৌলবাদী পুনর্জাগরণের ষড়যন্ত্র।
এই সমাবেশ ও এর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী এক ভয়ঙ্কর উদ্যোগ—যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনঃপ্রবেশ ঘটে।

 
                         
         
         
        